জুলাই সনদের খসড়ায় আইনি সুরক্ষা ও ভোটপূর্ব সুপারিশ বাস্তবায়ন

মানব কথা: সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে নেওয়া সিদ্ধান্ত যাতে পরবর্তী সরকারের সময়ও বাস্তবায়ন করা হয়, তা নিশ্চিত করতে আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা রেখে জুলাই জাতীয় সনদের একটি ‘সমন্বিত খসড়া’ প্রস্তুত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
সেখানে বলা হয়েছে, এই সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এই সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হলে এই সনদের প্রাধান্য থাকবে।
এই সনদের যেসব সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, দেরি না করে সেগুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবে সরকার।
সনদের সমন্বিত খসড়ার সঙ্গে আট থেকে দশ দফার একটি অঙ্গীকারনামা থাকবে, যেখানে এই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেবে রাজনৈতিক দলগুলো। সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ঐকমত্য কমিশন সংশ্লিষ্টরা সনদে সই করবেন।
‘সমন্বিত খসড়া’র আইনি দিকগুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে শুক্রবার রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে তা পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
প্রাথমিক খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন করে এই ‘সমন্বিত খসড়া’ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে দুই পর্বের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মতামতের প্রতিফলন রাখা হয়েছে।
এখন খুঁটিনাটি বিষয় পুনর্নিরীক্ষা করা হচ্ছে জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, বৃহস্পতিবারের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করে শুক্রবার সকাল নাগাদ তারা দলগুলোর কাছে এটি পাঠাতে চান।
১। ঐকমত্য কমিশন বলছে, প্রথম পর্বের সংলাপে ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬২টি বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ২০টি সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ১১টি বিষয়ে সবদলের সমর্থনে জাতীয় ঐকমত্য এবং ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া বাকি ৯টি বিষয়ে অধিকাংশ দলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
২। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্যে ২৯ জুলাই ‘জুলাই জাতীয় সনদের প্রাথমিক খসড়া’ পাঠানো হয়। তখনই জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি এই সনদ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আইনি সুরক্ষার দাবি জানায়, যা ‘সমন্বিত খসড়া’য় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
৩। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ কী হবে তা নিয়ে ঐকমত্য কমিশন তাকিয়ে রয়েছে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে।
এ সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা এবং সংস্কার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণের লক্ষ্যে গত ১০ অগাস্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এক দফা আলোচনা হয়েছে। এখন অঙ্গীকারনামাসহ এই ‘সমন্বিত খসড়া’ নিয়ে কমিশন সরকারের সঙ্গে আলোচনার করবে বৃহস্পতিবার।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই কমিশনের সভাপতি। মালয়েশিয়া সফর শেষে বুধবার রাতে তিনি দেশে ফিরেছেন। বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে দেখা করে সার্বিক বিষয়ে অবহিত করতে পারেন কমিশনের অন্য সদস্যরা।
কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বুধবার রাতে বলেন, “আমরা আশা করছি, পরশুদিন (শুক্রবার) সকাল নাগাদ আমরা সেটা (জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত খসড়া) দিয়ে দিতে পারব রাজনৈতিক দলগুলোকে। সেটার সামান্য কিছু বাকি আছে; খসড়াটা আমরা তৈরি করেছি। শেষ মুহূর্তে আরও কিছু জিনিস টুকিটাকি, বিশেষ করে অঙ্গীকারনামার জায়গাটায় আইনি দিকটা আমরা বিবেচনা করে সেটা পাঠাতে পারব।”
আলী রীয়াজ বলেন, “এটা নিয়ে একটু সরকারের সাথেও আলোচনা করতে হবে, তাদেরকে জানাতে হবে। এরপর শুক্রবার দলগুলোর কাছে পাঠাতে পারবো আশা করি।”
সংশ্লিষ্টরা জানান, অঙ্গীকারনামার প্রস্তাবিত দফাগুলো নিয়ে আইনজীবীদের মতামতও নেওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর এসব আইনি দিক চূড়ান্ত হবে।
অর্থাৎ, সমন্বিত খসড়া সনদের অঙ্গীকারনামায় যেসব বিষয় এসেছে, সেখানে আইনি দিকগুলোতে আরো পরিবর্তন আসতে পারে।
অঙ্গীকার নামা (সমন্বিত খসড়া)
১) গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
২) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ জনগণের সর্বজনীন অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রণয়ন করা হয়েছে বিধায় এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের একটা ব্যবস্থা (আইনি দিক আলোচনা চলছে) করা হবে।
৩) এই সনদের ব্যাখ্যার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকবে।
৪) জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-কে সম্পূর্ণ আইনগত বলবৎ হিসেবে গণ্য করা হবে।
৫) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এ দেশের শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
৬) ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করব। এই সনদের কোনো শব্দ, বাক্য ও নীতিমালা সংবিধান বা অন্য কোনো আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হলে এই সনদের প্রাধান্য থাকবে।
৭) গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকব।
৮) ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
৯) এই সনদের যে সমস্ত সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের যথাযত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংযোজন-পরিমার্জনের পর আইনি দিক পর্যালোচনা করে অঙ্গীকারনামায় দফার সংখ্যা কমানো বাড়ানো হতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “কবে নাগাদ জুলাই সনদ- সেটা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের আলোচনার তৃতীয় পর্বে, বিশেষত বিশেষজ্ঞদের মতামত পাওয়ার পর। আমরা যেটা বলেছি, প্রাথমিক একটা খসড়া দেওয়া হয়েছে সবাইকে, সে খসড়া অনুযায়ী তারা মন্তব্য করেছে।
“খসড়া থেকে এসব মন্তব্যের ভিত্তিতে সমন্বিত পূর্ণাঙ্গ খসড়া আবার পাঠাব আগামী দুদিনের মধ্যে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সকলেই একমত হয় স্বাক্ষরের দিন-তারিখ ঠিক করা যাবে।”
সূত্র: বিডি নিউজ