“ভালো কাজে আসক্তি বাড়াও আর বাজে কাজে ঘৃণা বাড়াও”

সময়: 2:50 pm - December 18, 2024 |

রাজু আহমেদ মোবারক:

1)”If someone won’t treat you right, they won’t teach you right.”

Farrah Gray- author of Reallionaire

আমরা যদি ভালো কিছু করতে চাই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর মানুষের জন্য তবে অন্তরের চরিত্রে যেন কিছুটা হলেও স্বচ্ছ থাকি সত্য সুন্দরের সন্ধানের মনোরম পথটিকে ধরে তোমার-আমার সেই অন্তর থেকেই। আমরা আমাদের হৃদয়ের স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়মিত ছেড়ে দিয়ে ভালো কাজের প্রতি আসক্তি বাড়াতে পারিনা। কারণ হৃদয়ের পরিসর বড় করেই আমাদেরকে অবশ্যই ভালো কাজের প্রতি আসক্তি বাড়াতে হবে। আর ভালো কাজের প্রতি আসক্তি বাড়ানোর জন্য আমাদেরকে অন্তরের সৌন্দর্যের স্বরূপটিকে বাঁচিয়ে রেখে সৎ হতেই হবে। আমরা অন্তরে সৎ না হওয়া পর্যন্ত কোন ভালো কাজ করার জন্য অনুভূতির বাঁধন অন্তরে তৈরি করতে পারবনা। কারণ মানুষ যদি অন্তরে সৎ মানুষই না হয়, ঐ মানুষগুলো সৎ চিন্তা, সৎ ভাবনা ও সৎ কর্ম করতে পারেন না। মানুষের এই সৎ কর্মই মহান মানুষের স্বীকৃতি দান করে। কারণ অন্তরে মলিনতার ছাপ রেখে তুমি কখনোই সৎ পথে চলার অভ্যেস করতে পারবে না। তোমার ভালো কাজের আসক্তি হৃদয় থেকে তখনই তীব্র হবে,যখন এটা-ওটা-সেটা-একটু-আধটু-এখানে-সেখানে এই সমস্তের মাঝে এলো মেলো ভাবে ঝুঁকে না গিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন পছন্দের পথের দিকে যেতে থাকো। তোমার নিজের বাজে কাজে যদি তোমার নিজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি না হয়, তুমি তোমার নিজেরই অন্তর দ্বারা সৃষ্ট একজন অপদার্থ কুৎসিত চরিত্রের মানুষ। কারণ তুমি তোমার নিজের অন্তরের সৌন্দর্যহারা মানুষ হয়ে অন্তরের স্বচ্ছ রুপটি অস্বচ্ছ করে ফেলেছো যা তোমার জন্মকালে তা জানারও দরকার ছিলো। অন্তরে যারাই অপদার্থ ও কুৎসিত মানুষ হবেন, তাদের ভালো কাজে আসক্তি না থাকার কারণে তারা তাদের জীবনে কোন কিছুই গোপন রাখতে পারেন না। কারণ তাদের দ্বারা সৃষ্ট অপরাধের অগ্নিশিখা তাদের পেছনে থেকে থেকেই অগ্নিস্ফুলিংগ সৃষ্টি করে বড় ধরনের অগ্নিবিস্ফোরণও ঘটায়। এই অগ্নিস্ফুলিংগের অগ্নিবিষ্ফোরণ দেশের সকল মানুষেরাই বেলা অবেলায় শোনে থাকেন। আমরা যদি সত্য সুন্দরের সন্ধানের পথে থেকে আমাদের জীবন চালিত না রাখি, ভালো কাজে আসক্তি বাড়িয়ে জীবন চালানো বেশ কঠিনই শুধু নয়, আমরা আমাদের রুপ চরিত্রে নির্ঘাত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশিষ্টজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন জগতের কেবলই চিন্তাক্লিষ্ট দুর্বল প্রকৃতির মানুষ বিকাশের শক্তিতে। তোমার-আমার জীবন যদি মন্দ কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে আমরা যত কিছুই গোপনে করে যেতে থাকি না কেন, কোন কিছুই আর গোপন থাকে না। আমাদের মৃত্যুর পরে হলেও গোপন কাজের গোপন ফল অগ্নিস্ফুলিংগের মতোই অগ্নিবিষ্ফোরণ ঘটাবে। তা যে নিয়তিরই খেলা তা কি আমরা একেবারেই জানি না? আমরা যেন কিছুতেই অন্তরের সৌন্দর্যের স্বচ্ছ রুপটি ধূসর বর্ণে পরিণত না করি। চরিত্রের সুন্দর রুপটি তখন হারিয়ে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের দুষ্ট মানুষের সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে ওরা ভন্ডামিতে ব্যস্ত থাকেন। আমরা মানুষ হিসেবে যখনই সত্য সুন্দরের সন্ধানে থাকার জন্য মনকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য আত্নপ্রত্যয়ী হই, তখনই মস্তিষ্ক থেকে সৎ চিন্তা, সৎ ভাবনার শক্তিতে আমরা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি সৎ কর্ম সম্পাদন করার জন্য। আপনি যদি একদিন পাপের কাজ করেন, আর অন্যদিন পূণ্যের কাজ করেন তাহলে আপনার অন্তরে সৎ চিন্তা ও সৎ ভাবনা উদিত হবে না। কারণ সৎ কর্ম সাধিত করার জন্য প্রতিদিনই আপনাকে সৎ চিন্তা ও সৎ ভাবনার মধ্যেই থাকতে হবে। আপনার-আমার জীবনে ভালো কিছু অর্জন করার জন্য অন্তরে সততার চরিত্রের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকতেই হবে। কারণ মানুষ তাদের অন্তরের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের আলোকেই সুন্দর মনের মানুষ হয়ে থাকেন। প্রত্যেক জাতিই তার হাজার হাজার বছরের জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তাদের চলনে-বলনে-বৈশিষ্ট্যে তা প্রকাশ করে থাকেন। ঠিক তেমনই ভাবে প্রত্যেক মানুষই তার অন্তরের সৌন্দর্যে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মানুষ হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে সাংস্কৃতিক চেতনা বোধের অনুভূতির আলোকে। আমাদের অন্তরের সাংস্কৃতিক চেতনা বোধই আমাদেরকে চালিত করে ভালো কাজের সন্ধানে নিজস্বতার স্বরূপ দিয়ে। আমাদের মস্তিষ্কে যা অনুপ্রবেশ করাই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণে, আমরা সেই মানুষই হয়ে থাকি ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে। যারাই অন্তরের সৌন্দর্যে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে পারেন, তারাই জাতি সত্তার শেকড় সাথে নিয়ে সামনে যেতে পারেন। আর যাদের অন্তরের সৌন্দর্যের সংস্কৃতির অভাব থাকে, তারাই চুরি-দুর্নীতি-ঘুষ-হত্যাকান্ডসহ এসব নষ্টামী ও ভ্রষ্টামির কাজে লিপ্ত হয়ে যান। তাই তো মানুষের অন্তরের সৌন্দর্য একদিনে পরিপুষ্ট হয়ে বিকশিত হয় না। আর আমরা যদি আমাদের বাজে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই বাজে কাজের প্রতি ঘৃণা বাড়াতে হবে। আপনি যখনই কোন বাজে কাজকে নিম্ন বলে অন্তরে বাঁধা পদান না করেন, একে সমাজ ও রাষ্ট্রে টেকসই মানুষ হিসেবে টিকে থাকার জন্য জীবনের বড় অংশ বলে স্বীকৃতি দিয়ে আপনার আদর্শিক চেতনার ওপর নিজের অন্তরকে দাঁড় করাতে চান, তাতে আপনার অন্তরের চেতনার রুপটি চিরকালের জন্যই অসুন্দর হয়ে থাকবে। কেউ যদি তোমাদের প্রতি বা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি এমন নিষ্ঠুর কর্মকান্ড করে ফেলে যা তোমাদের বুকে বেদনা সৃষ্টি করে তা সারাক্ষণ হৃদয়ে সঞ্চারণ করে রাখে, তখনও তোমরা তাদেরকে ঘৃণা করতে না চাইলেও আপনা থেকেই তাদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে যাবে। কারণ, ঘৃণার কাজ যারাই করেন কোথায় থেকে কি ভাবে তাদের ওপর ঘৃণা বর্ষিত হয় কেউই তা জানেন না। ঘৃণার কাজের দ্বারা যারাই ঘৃণিত হয়ে যায়, তারা অন্য মানুষের ঘৃণা না পাওয়া থেকে মুক্তি পেতে পারেন না। যে জিনিসের যে রুপ, সেই জিনিসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মানুষের কৃতকর্মে তাদের ওপর অর্পিত হবেই। ঘৃণার কাজ যারাই করে থাকেন, তারা তাদের চিরকালের ঘৃণা নিয়ে মৃত্যু বরণ করার যোগ্য। আমরা যদি আমাদের ভালো কাজের প্রতি আসক্তি না বাড়িয়ে চলি, অন্যের খারাপ কাজে ঘৃণা করার জন্য যে অন্তরের ভেতরে ঘৃণার চেতনা উদিত হয়, সেটাও নানান কারণে সম্ভব হবে না। যে সমস্ত মানুষেরা বাজে কাজের আসক্তিতে নিমজ্জিত থাকেন, তারা তো কখনোই বাজে কাজ করার পরে যে অনুশোচনায় অন্তরে জ্বালাতন সৃষ্টি হয়, তা তাদের হৃদয়ে অনুভূত হয় না। কারণ, তাদের অন্তর পাপ ও তাপে এমন ভাবে জ্বলে ধূসর হয়ে হয়ে থাকে, তা তারা কালো ধোঁয়া মনে করে স্বাভাবিক মনে করে চলেন। এই মানুষগুলোর দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন কল্যাণ হতে পারেনা। কারণ, তাদের অন্তরে বিলুপ্ত হয়ে আছে মনুষ্যত্বের বিকাশের মূল শক্তি। তুমি যদি ভালো করে ফুটবল খেলা শিখতে চাও কোন একটি মাঠে প্রশিক্ষকের দ্বারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তবে সেই মাঠটিকে প্রথমেই উপযুক্ত করে রাখো প্রশিক্ষণের জন্য। সেই মাঠের সবুজ ঘাস ছোট করে একবারে সমান্তরাল মসৃণ মাঠে পরিণত করে প্রশিক্ষণের উপযুক্ত করতে হয়। প্রতিদ্বন্দীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে খেলার জন্য যে উপযুক্ত মাঠ দরকার, অনুশীলনের মাঠটিও সেই একই পরিমাণ উপযুক্ত হতে হবে। আমাদের জীবনের জন্যও উপযুক্ত জিনিস চাই যা দ্বারা নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করা যায় মানুষের সাথে। আমরা জীবনে যত কিছুই অর্জন করে থাকি না কেন, সত্য সুন্দরের সন্ধানের পথ থেকে বিচ্যুত হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের কোন অপরাধ ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কোনই প্রতিবাদ করার সাহস পাবনা। তোমরা একটি কাজ করো: “তোমরা সত্য পথে তোমাদের মনটি রাখো, নিজের দেশকে ভালোবাসো, সারা পৃথিবীকেও যত্ন করো।”

2)”Don’t be discouraged. It’s often the last key in the bunch that opens the lock.”-Anonymous

আপনার জীবনেও যদি আপনার নিজের আগামীর ভবিষ্যতের জন্য অন্তরের সৌন্দর্য্যে চিন্তা ভাবনা না করে থাকেন এবং সেই সাথে আপনি যদি অন্তরে পরিমিত পরিপাটি ও পবিত্র না থাকেন, আপনি সহজেই ভালো কাজের প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে যে ভালো মানুষ হবেন, সেটাও সম্ভব হয়ে উঠবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে চতুর্দিকে যদি গোলযোগ থাকে আমরা চাইলেও এত গোলযোগের মাঝে শান্তি সৃষ্টি করে চলতে পারি না। বিশেষ কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করেই সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি সৃষ্টি করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আনতেই হয়। আমাদের অন্তরের মাঝে যখনই ভালো ও খারাপ কাজের মিশেলে অন্তরকে পরিচালিত করি, আমাদের অন্তরের মাঝেও এক ধরনের গোলযোগই সৃষ্টি হয়। আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সারা বিশ্বে যত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে অস্থিরতার রুপ ধারণ করে, তখন মানুষ ছন্নছাড়া জীবনের মধ্যে পড়ে সমস্তই তাদের নিঃশেষ করে ফেলে। তাও কিন্তু নিষ্ঠুর মানুষদের অন্তরের নিষ্ঠুরতার গোলযোগের কারণেই। এই অধিকাংশ নিষ্ঠুর মানুষেরা তাদের জীবনে ভালো কাজের প্রতি আসক্তি অন্তরে বিকশিত করেননি, কারণ তা তাদের চিন্তা ও মনন শক্তির বিকাশের প্রতুলতা তাদের জীবনকে অনুভবের শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তুমি যদি মানুষের দুঃখ দুর্ভোগে তোমার অন্তরে অনুতাপের মাত্রা যোগ করে তোমাকে বড় বেশি ব্যথাতুর করে না তোলে, তুমি সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীতে বড়ই নিষ্ঠুর মানুষ, কারণ বাজে কাজের প্রতি যদি ঘৃণা করার ঘৃণার অন্তর আপনার নিজের প্রাণে বা চেতনায় না থাকে, আপনার মন বিশেষ বিশেষ মূহুর্তে বিশেষ বিশেষ খারাপ কাজ করতে তৈরি হয়ে যাবে। আপনার জীবনে আপনার প্রয়োজনে নানান অপকৌশলে নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষকে দমন করে শাস্তি দিতে পারলেও আপনি যদি আপনার মনের সৌন্দর্য্যে পরিমিত সুন্দর মনের মানুষ না হোন, আপনি আপনার নষ্ট মনকে নিয়ন্ত্রণ করে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারবেন না। আপনি তখনই ভালো ও সৎ মানুষ হতে পারবেন, যখন যত প্রকার বাজে কাজ আছে সেইগুলোকে ঘৃণা করতে শিখবেন। আপনার অন্তরটি পবিত্রতার পরশে ছোঁয়া লাগিয়ে ভালো কাজের প্রতি আসক্তি বাড়ানোর জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করবে। কারণ, আপনার-আমার অন্তর পাপের ছোঁয়া থেকে দূরে থাকবে এবং খারাপ কাজে ঘৃণার বহর অন্তরে উদিত করতেও শুরু করবে। আমরা যখনই মন্দ কাজকে ঘৃণা করার অভ্যেসের মাঝে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হবো, আমাদের মনের অজান্তেই আমরা কেবলই ভালো কাজের প্রতি আসক্তি বাড়িয়ে চলতে সক্ষম হতে শুরু করব। আমরা যদি আমাদের জীবনকে প্রাণপণে বুঝার চেষ্টা না করি, জীবন চলার পথে সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর কৌশলের সাথে নিজে কৌশল করে জীবন চালিত করার জন্য কৌশলের বুদ্ধি বিস্তৃত করে না চলি, জীবনের বিশালত্বও তখন গতিময় করা যায় না। কারণ, মানুষের জীবনে তাদের ভালো কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে যদি বিস্তৃত করা না যায়, জীবনের বিশালত্বের শক্তির ভেতরে ঢুকে স্হায়িত্ব হয়ে থাকাও যায় না। আমরা আল্লাহ্‌র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হওয়া সত্ত্বেও কিসে আমাদের ভালো, কিসে আমাদের মন্দ এসব হৃদয়ে অনুভব করার পরও যদি আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ না করে মন্দ কাজের দিকেই মনকে এলিয়ে দুলিয়ে রাখি, তখন আমরা আমাদের নিজেদেরকেই সংগায়িত করতে হয় যে, আমরা আসলেই খারাপ মানুষ। তুমি যদি তোমার নিজের কারণে জীবনে কিছু খারাপ কাজ করেও থাকো, সেই ক্ষেত্রে তোমার অন্তরের ঘৃণার বাক্সটি যদি না খোলে থাকে, তোমার নিজের ওপর ঘৃণা

সৃষ্টি না হলেও তোমার নিজের মানুষই তোমাকে তোমার কৃতকর্মের জন্য ঘৃণা করতে শুরু করে দিবে। তোমার দ্বারা সৃষ্ট খারাপ কাজে তোমার হৃদয়-মন তোমাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও আরো তুমি খারাপ কাজই করলে! তাতে যদি তোমার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ তোমাকে ঘৃণা করে সেই-ই তো তোমার প্রাপ্য। তোমরা হয় তো মনে করতে পারো তোমাদের প্রতি মানুষের ঘৃণা তোমাদের শরীরকে করছে, আসলে তা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। মানুষ ঘৃণা করে তোমাদের দ্বারা সৃষ্ট মন্দ কাজের মন্দ হৃদয়কে। কারণ, তোমরা প্রাণহীন ও হৃদয়হীন মানুষ বলেই তো চুরি-দুর্নীতি-ঘুষ-হত্যাকান্ডসহ এসব জঘন্যতম কাজ করে থাকো। সৃষ্টিকর্তা আমাদের মৃত্যুর পরে যে আমাদের জীবনের কৃতকর্মের হিসেব-নিকেস নিয়ে যার যার প্রাপ্যতা দান করবেন, তা তো আমাদের শরীরের নয়, তা আমাদের হৃদয়-মন-কর্মের। আমাদের শরীর তো আমাদের চালায় না। আমাদের মনই মস্তিষ্কের শক্তির বিকাশে পরিচালিত করে আমাদেরকে চালায়। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে পুরস্কারই বলো, আর শাস্তিই বলো সবই তো হবে আমাদের মন, হৃদয় দ্বারা কর্মের ফল। এই দুনিয়া ও সেই দুনিয়া যে দুনিয়ার কথাই বলো, ভালো কাজের ভালো ফল আর মন্দ কাজের মন্দ ফল আল্লাহর কাছে জমা আছে।

আমাদের পবিত্র কোরানেও বলা আছে যা কিছুই হয় বা ঘটে তাঁর ইচ্ছেমত হয়। আমাদের সকলকে মন্দ কাজের শাস্তি যদি পেতেই হয়, তা তো হবে আমাদের মনের নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের জন্য। বিধাতার দেওয়া শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়ে আমরা যদি বাঁচতেই চাই, সহজ কাজকে কঠিন না করে সহজ স্হানেই যেন আমাদের মনকে রাখি পবিত্রভাবে। যাতে আমাদের অন্তরকে স্ফটিকের মতোই স্বচ্ছ রাখে। এই স্বচ্ছ প্রাণ-মন কখনোই আপন গতিতে অন্তরে সৃষ্টি হয় না। যদি আমরা সত্য কথা বলতে ভয় পাই, সত্য কাজ করতে দূরে থাকার অভ্যেস করি তাহলে ভালো কাজ করার প্রতি আসক্তিটা কমে যেতে পারে, কারণ সত্য সুন্দরের সন্ধানে থাকার পথ থেকে আমরা দূরেও চলে যেতে পারি। কোন ভালো কাজের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি আর খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা বৃদ্ধি তখনই হয়, যখন মানুষ সত্য সুন্দরের সন্ধানে থেকে সত্য কথা বলতে ভয় না পায়। তুমি যদি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প করে থাকো, তোমার কিন্তু মানুষের মধ্যে বিচরণে থেকেই মানুষের জন্য কাজ

যেমন করতে হয়, মানুষের জন্য কথা এই দু’টি-ই করতে হয়। এই কথা ও কাজ করার সময় তুমি সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষের ওপর ছবি আঁকতে সমর্থ না হও, অনেক ভালো কাজও ভালোভাবে করা যায় না। এইও সত্য যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর ছবি আঁকার পূর্বে নিজের চরিত্রের ওপর ছবি আঁকতে হয় সব কিছুরই আগে। কারণ, নিজেকে নিজের অন্তরে সমর্পণ করে নিজের ছবি আঁকতে হয়। নিজেকে তখন দেখা যায় আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতো একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে। নয় তো পৃথিবীর জঘন্যতম মানুষ হিসেবে যা তুমি সারাকাল বুদ্ধি দিয়ে অর্জন করেছো চোর-ডাকাত-দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ হিসেবে।

3) “Never let a day pass without looking at some perfect work of art, hearing some great piece of music and reading, in part, some great book.”-German philosopher Goethe

আমি যদি আমার ময়লাযুক্ত শরীর নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, আমি আমার পরিস্কার শরীরটা নয়, ময়লাযুক্ত শরীরটাই তো দেখবো। আমি যা আছি, তা-ই আমি। আপনার-আমার অন্তর যদি কর্দমাক্ত থাকে, আমাদের বাহিরের কর্মকান্ড অন্তরে যা থাকে সেই অনুসারেই হবে। নিজের ওপর নিজেকে জানার জ্ঞান যে অর্জন করতে পারেন,

মনের মাঝে সুন্দর চেতনাবোধের সংস্কৃতি যে বাড়তে থাকে সেই সম্পর্কেও জ্ঞানার্জনের জ্ঞান থাকে। কারণ মানুষ যখন মন্দ কাজ করতে করতে অন্তর থেকে নিন্ম মানের রুচিবোধের মানুষে পরিণত হয়ে যায়, তারা তাদের অন্তরের সৌন্দর্য নষ্ট করে সমাজে ও রাষ্ট্রে যা খুশি তা-ই করতে পারেন। কারণ মানুষের যখনই বিবেক ও মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটে

তাদের হৃদয়ের সংস্কৃতি থেকে, তখনই মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রে যা খুশি তা-ই করার চেষ্টা করেন। তারা এমন মানুষ হয়ে পড়েন যে, তাদের চলমান জীবনে চলতে গিয়ে দিগ্বিদিক কোন জ্ঞান পর্যন্ত থাকে না। আমরা মানুষ হিসেবে যদি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে মৃত্যু অবধি জীবন চলমান রাখার সময় মনের সৌন্দর্য থেকে বাহিরে বের হয়ে ভালো কাজ না করি, মনের ভেতর অতি সহজেই অন্যের সুখের জীবন দেখে ইর্ষা-বিদ্ধেষ জন্ম হতে থাকে। ফলে তা-ই ধীরে ধীরে অন্তরে বড় হতে শুরু করে নিজেদের অন্তরের রূপের সৌন্দর্যের স্বরূপ নামে যে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা আছে, সেটাকে ধ্বংস করার জন্য। এই বড় হওয়া ইর্ষাই জীবনের একটা বিশেষ মুহুর্তে তার চরিত্রের আসল রুপটির সৌন্দর্য হারিয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে। তারা নিজেরাও একদিন মানুষের যাতনার ভার অন্তরে ভারি করে ইর্ষার বিষে জ্বলতে জ্বলতেই তারা পুড়ে মরে। সেই ইর্ষার বিষের যাতনা অন্যেরা সবটুকু না দেখলেও তিনিই শুধু বুঝেন যিনি মানুষের ক্ষতিসাধন করেন। এই জ্বালা যে বড় জ্বালা, তারা তাদের জীবন সায়াহ্নে এসে হাঁড়ে হাঁড়ে অনুভব করেও চলেন। কারণ সমস্ত জীবনে তাদের অপরাধ কর্মে তারা একটা সময়ে বড়ই একা হয়ে পড়েন। যে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখে দেখে প্রাণের তৃপ্তিবোধে শান্তি লাগতো প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে এখন এসব আর তাদের এতটা ভালো লাগেনা! কারণ সারাকালের অপরাধ বোধের যন্ত্রণা শুধুই ঘৃণার বাঁশির আওয়াজ পাচ্ছেন। অপরাধ ও পাপেতে অন্তরের শান্তি বেশি নষ্ট হয়ে গেলে পরে শান্তি পাবার আর শান্তির পথ খুঁজে পাওয়ার আর পথ থাকে না। সব পথই তখন শেষ হয়ে যায়! শেষের পথের অশেষটি যেন চিরকালের! এযে জীবনের জন্য একটি ভয়ানক পথ! আমরা সকল মানুষকে প্রণাম-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানাতে পারি এমন মানুষ যেন হই আমাদের ভালো কাজে আসক্তি বাড়িয়ে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের নিজেদের জীবনকে উন্নত জীবনের মূল ধারাতে প্রতিস্থাপিত করার জন্য সর্বসময়ই বাঁকা পদচিহ্ন প্রতিটি প্রদক্ষেপে রেখে চলি, একদিন হয় তো এই বাঁকা পদচিহ্নের অপশক্তির ফলাফল সমাজ ও রাষ্ট্রের মাঝে আমাদেরকে ঘৃণিত মানুষে পরিণত করে নিজেদের অন্তরে শুধুই যেন গ্লানির মাত্রা ত্বরান্বিত করবে। তুমি যদি তোমাকে জানার ও চেনার কোন হেতু নিজেকে প্রশ্ন করে জানতে না চাও, তুমি তোমার নিজের জীবনের নিজের চেতনাকেই বুঝতে পারবেনা আসলে তোমার অন্তরের চেতনার রুপটি কি? যা আপনাকে আপনার চেতনাবোধ দ্বারা মানবিক মানুষ হিসেবে নির্ণয় করে। আপনার-আমার অন্তরের চেতনাকে মৃত রেখে আমরা অন্য মানুষের দুঃখকষ্ট দেখার পরও আমাদের অন্তরের ঘৃণা করার ঘৃণার বাক্সটি খুলতে পারবনা। তোমরা অপরাধীর অপরাধ দেখে অন্তত দেশ জাতিকে বলে দাও তোমাদের ঘৃণার আগুন দ্বারা যে, ওরা সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর উচ্ছিষ্ট পদার্থ। আমাদের খারাপ কাজ করার মাঝে যতক্ষণ আমাদের অন্তর থেকে ঘৃণা করার প্রাণের সঞ্চারণ না ঘটবে, জীবনে কোন খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকার জন্য উত্তাল প্রাণ আমরা আর কখনোই পাবনা। কারণ পৃথিবীর কোন মহত্বের কাজ সম্পাদন করার জন্য সরস ও উত্তাল প্রাণের প্রয়োজন হয়। যে প্রাণের ভেতরে নগ্নতার বীজ রোপণ করা নেই, সেই কাজ যিনিই করবেন তারাই সত্য সুন্দরের সন্ধানে থেকে জীবন চালিত রাখতে পারবেন। আমাদের প্রাণের সৌন্দর্য যখনই নষ্ট হয়ে যায়, আপনার-আমার দ্বারা কোন ভালো কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। আপনার-আমার সকলের সুন্দর জীবন মানুষকে নিয়েই। আপনার-আমার জীবনে পরিপূর্ণ আনন্দ তৃপ্তি যদি অন্তরে অনুভব করতেই চাই, সেই আনন্দ তৃপ্তিবোধ যেন প্রিয়জনদের সাথে ভাগাভাগি করেই নেই। আপনি একা একা হেসে দেখুন, সেই হাসিতে অন্তর থেকে হাসির সৌন্দর্য ফুঁটে উঠবে না। হাসির সৌন্দর্য ফুঁটিয়ে তোলার জন্য সংগে কিছু সংগী সাথীরও প্রয়োজন হয়। এই পৃথিবীতে জীবজন্তু, গাছগাছালী, পশুপাখি, নানান সৃষ্টির মাঝে আমরা বিভিন্ন পরিচয়ে বিভিন্ন নামে ভূষিত হয়ে আছি। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-ইয়াহুদী আমরা সকলেই যদি একটি বৃন্তে এই পরিচয়ের

পরিচয়পত্র দানে মানুষ হই। আমরা বিভিন্ন নামে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নাম ধারণ করে মানুষ হিসেবে চললেও আমরা যদি মানুষ হয়েও জগতের কোন কল্যাণ সাধন না করে মরি, আমাদের জন্মটা যে মোটেই শোভন হলো না তা-ই কিন্তু বলা চলে, তা-ই যুক্তি গ্রাহ্য ও হিসেব গ্রাহ্যও।

আমরা পৃথিবীতে যে জাতির মানুষ নামে পরিচিত হয়ে পরিচিতি লাভ করি না কেন, মানুষের মর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও মনুষত্ব নামে যে গুরুত্বপূর্ণ মানবিক উপাদান রয়েছে তা যদি মানুষের অন্তরে বিকশিত না হয়, মানুষের মাঝে চিরকালই বিদ্ধেষী সম্পর্ক পরস্পর পরস্পরের মাঝে বেড়েই চলবে। কারণ এসব বিদ্ধেষী সম্পর্কের প্রধান উপাদানই হলো লোভ লালসা সংবরণ করে সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে মানুষ হয়ে না থাকার মানসিকতা। আমাদের অন্তঃচেতনার মাঝে যদি ভালো কাজ করার আসক্তি বৃদ্ধি না করে চলি এবং অন্তরের যত্নের চর্চাও শুরু না করে চলি, সেই অন্তরের মাঝে নিজের অন্তরকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। কারণ আমরা কখনোই আমাদের অন্তরের যত্ন ব্যতীত আমাদের নিজেদের কাজের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি করতে পারি না। আমাদের ভালো কাজের প্রতি আসক্তি সৃষ্টি করে ভালো কাজের সন্ধান লাভ করার জন্য ঘৃণিত ও নিষ্ঠুর কর্মকান্ড থেকে নিজেদের অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি করেই দূরে থাকতে হয়। তুমি যদি তোমার জীবনের উন্নতির জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রে তোমার চেয়ে পিছিয়ে আছে সেই মানুষগুলোকে পীড়া দিতে থাকো, তাদের সেই পীড়ার যাতনার ভার তোমাকে আজ না হয় কাল, তোমার পিছন থেকে হলেও কেউ একটি পাথর ছুড়ে মাথা ফেটে হলেও রক্তের বন্যা বয়ে দিয়ে যাবে। তখন তুমি এমন একটি কঠিন সময় জীবনের মুখোমুখি হবে, সেই পীড়ার পীষণ বড়ই বেদনাদায়ক হবে। কারণ যুগের পরিবর্তনে যুগে যুগে নতুন নতুন জিনিস যেমন আবিষ্কার হয়ে মানুষের কল্যাণ সাধিত হচ্ছে। সেই কল্যাণের মাঝে অকল্যাণও অনেকের জীবনে বিভিষিকাময় মনে হয়। তুমি যদি মনে করো মানুষকে ঠকিয়ে বড় কিছু অর্জন করবে তা তুমি অর্জন করতে পারবে। মানুষকে ঠকিয়ে যারাই কিছু পেয়েছেন, তাদেরকে ফেরত দিতেও হয়েছে শেষ বেলাতে সুদাসলে। তোমরা যদি মানুষের অকল্যাণ করে কোন শহরের বা দেশের মালিকও হয়ে যাও। মনে রাখিও, শেষ বয়সে গিয়ে যদি সমস্ত অপশক্তির পীড়ার যাতনায় তোমাকে আঘাত দিতে থাকে, আর তুমি অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকো, যাদের নিয়ে তোমাদের বিশালত্বের জীবন ছিল, যেখানে আনন্দ বিলাসের অভাব ছিল না, তারাও তোমাদের পাশ কেটে দ্রুতই চলতে থাকবে । কারণ বেলাশেষে চাইলেও অনেক ভালো কাজও করা যায় না। শেষ বয়সে আমরা আমাদের নিজেদের ঘরে বাস করে যদি মৃত্যু বরণ করতে চাই, মানুষের মঙ্গল সাধনের মধ্য দিয়েই যেন জীবনটা চালিয়ে যাই সত্য সুন্দরের সন্ধানের পথে থেকে।

4)”He who has a why to live for can bear almost any how.”–

Dr. Victor Frankel

আমাদের অন্তরের যদি যত্নের অভাব পড়ে, সেই অন্তরের সৌন্দর্যের স্বরূপ কাঠামো খোঁজতে গিয়ে তা আমাদের নিজেদের মাঝে তা আর খোঁজে পাবনা। কারণ, আপনার-আমার অন্তরে অন্তর্গত হতে শুরু করে নিজেদের ও অন্যের দ্বারা সংগৃহীত নানান আবর্জনা। তাই সকলেই যেন নিজেদের অন্তরের যত্নটুকু করি। শেষ বয়সে গিয়ে যেন পূর্বের পাপের বোঝার কারণে কঠিন বাঁধনে পড়ে ছন্নছাড়া জীবনে পড়তে না হয়। এই সত্যটি বার বারই বলে যেতে হয় যে, আমরা সত্য সুন্দরের সন্ধানে থেকে পরকালের জন্যও যেন ভালো ভালো কাজ করে পূণ্য অর্জন করে সংগে নিয়ে যাই। আমাদের জীবনে যেটা ভালো সেটা করেই তো তা নেওয়া চাই। যা আমাদের চরিত্রে অর্জন করলে সর্ব দিকে সকলেরই ক্ষতি হয় তা পরিত্যাগ করাই উত্তম। মানুষের অন্তরের শ্রেষ্ঠত্ব এবং এর ভেতরের সৌন্দর্যের প্রাচুর্য্যতা যদি জল তরঙ্গের মতো দোলা সৃষ্টি না করে চলে, মানুষ তাদের আপন মানুষের সাথেও অন্তরের সম্পর্কে রুপ তরঙ্গের প্রবাহ দেখতে পায় না। বিশেষ করে পরিবার ও সমাজে চলতে গিয়ে দশ দিগন্তের বন্ধন প্রয়োজন হয়। যে বন্ধনে বিবেকের সৌন্দর্যে যারাই আবদ্ধিত হবেন জীবনে দায়িত্ব পালনে তাদের অনুভূতির বন্ধনে, সেখানে তো মাথার ওপর কিছুটা ভারি জিনিস বহন করে নিতেই হবে। দশ দিগন্তে কি হচ্ছে তা যদি না জানা যায়, হালকা জিনিসও যখন মাথার ওপর পড়ে, তখন তা বেশ ভারি বলেই মনে হয়। যে মানুষেরা তাদের নিজেদের অন্তরে বড় চিন্তা ও চরিত্রের রুপ কাঠামোতে বড় মানুষ হবেন, তারা শুধুই এই পৃথিবীতে আপন প্রাণে নিজেদের জন্যই কষ্ট করে চলেন না। তারা পরের জন্য কাজ করে যে, ত্যাগ স্বীকার

করেন তাতেই শান্তি পেয়ে থাকেন। কারণ, যারাই পরের জন্য কাজ করে থাকেন, তারা তাদের নিজেদের অন্তরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে রাখেন। মানুষের জন্য যদি আমরা অনুভূতির বাঁধন সৃষ্টি না করে চলি, আমরা সম্পর্কে প্রাণ সৃষ্টি করে চলতে পারি না। আমাদের আপন মানুষও পর হয়ে যায় অনুভূতির বাঁধন না থাকার কারণে। মানুষে মানুষে অনুভূতির বাঁধন ছাড়া নিজেদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে তৈরি করা কঠিনই হয়ে পড়ে। আজকাল আমরা সমাজে সমাজে যতটা না সম্পর্কের বাঁধন নষ্ট হতে দেখি, তার চেয়েও যেন এই সম্পর্কের বাঁধন বেশি নষ্ট হতে দেখি পরিবারে পরিবারে। পরিবারে পরিবারে সম্পর্কের বাঁধন পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ সম্পদের মাঝে পরিবারই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। এই পারিবারিক বাঁধন সামান্য ও তুচ্ছ বিষয় দ্বারাই নষ্ট হতে চলছে অধিকাংশ শিক্ষিত পরিবারেই। যে পরিবারের বাঁধন বর্তমান সময়ে ভালো আছে, তারা হয় তো বিবেকবান, ধৈর্যশীল ও লোভমুক্ত মানুষ। আমরা মানুষ হিসেবে যদি সততার চরিত্র ও হিংসাত্বক মানসিকতা অন্তর থেকে বিদূরিত করে রক্তের বাঁধনকে দৃঢ় করে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতে শিখি, তবেই আমাদের অন্তর থেকে বের হয়ে যাবে পিচ্ছিল রসগুলো। যা আমাদের অন্তরকে নেড়ে ছেড়ে এর রুপের বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যকে দুর্বল করে রাখতে না
পারে। এই পরিবারের রক্তের সম্পর্কের বাঁধন যখনই নষ্ট হয়ে যায় তখন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ে। কারণ, আমাদের পরিবারের লোকজন সমাজ ও রাষ্ট্রেরই একটি অংশ। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র এই ত্রিমাত্রিক বাঁধনই সকল শক্তির উৎস মানুষের মনুষ্যত্ব ও বিবেকের উৎকর্ষতার বিকাশে। এই ত্রিমাত্রিক বাঁধন যখন পরিবার ও সমাজ ও রাষ্ট্রে বিকাশ লাভ করবে, মানুষে মানুষে অন্তরে অনুভূতির চেতনাও প্রখর হতে থাকবে। ফলে মানুষের অন্তর থেকে স্বার্থপরতার মনোভাব সামান্য হলেও কমে আসবে। আমরা যদি পরিবার ও সমাজের মানুষের সাথে মনোরম প্রাণ দ্বারা মনোরম সম্পর্ক স্থাপিত করে সমস্ত ক্ষেত্রে স্বার্থপর সম্পর্ককে আমাদের অন্তরের মনিকোটা থেকে বিতাড়িত করতেই চাই তবে আমরা যেন হিংসাত্বক ও লোভনীয় মনকে নিয়ন্ত্রণ করে চলি। কারণ, সকল অসুন্দরের বিষাক্ত শক্তিই হলো হিংসা-লোভ-পরশ্রীকাতরতা। এই একটি সত্যকে আমরা মেনে নিতে পারি না। আর তা হলো, তুমি-আমি যখনই অন্তরের পবিত্র সুন্দর স্বভাবকে সৌন্দর্যহীন করে ফেলি, আমাদের মন্দ কাজে যে নানান সুবিধা আছে, সেই সুবিধার ফল ভোগ করার জন্য আমাদের অন্তর সামান্য একটু ছিদ্র পেলেই, এই ছিদ্রের ভেতর ঢুকে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। এই মানুষগুলো তখন বুঝতেই চান না যে, তাদের এই ছোট ছিদ্র যে একদিন বড় ছিদ্রতে পরিণত হয়ে তাদেরকে মহা সমুদ্রে সাতার কেটে তীরে উঠাচ্ছে। এই মহা সমুদ্রের তীরে যে সারি সারি মানুষের আগমন হচ্ছে। যারা তোমাদের ব্যাঘ্রের বিষাক্ত নখের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল তাদের পুরো শরীরে। তাদেরই কেউ কেউ আজ তোমাদেরকে দেখতে এসেছেন তাদের মনের জ্বালার যন্ত্রণা দূর করার জন্য। আমরা সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতিকর কাজ করে খারাপ কাজে আসক্তি বাড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমরা ভালো মানুষদের স্বীকৃতি থেকে চিরকালের জন্যই বঞ্চিত হয়ে গেলাম। আমরা মানুষ হিসেবে যেন ভালো কাজে আসক্তি বাড়িয়ে চলি আর খারাপ কাজে ঘৃণার আসক্তি বাড়িয়ে চলি। যাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষেরা আমাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আমরা যেন সমাজ ও রাষ্ট্রে আক্রমণাত্মক মানুষ না হই। তার জন্য আত্নশাসন ও আত্নংবরণ বিশেষ প্রয়োজন। আমরা যদি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আত্নসন্মান নিয়ে বাঁচতে চাই তবে নিজেদের ওপর

আত্নশাসন দরকার। যারাই অন্য মানুষের জীবনের ওপর বেশিই ঘাটাঘাটি করে চলতে চায়, তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর ঘাটাঘাটি শুরু করেন। ফলে তোমার-আমার জীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য যে আত্নশাসন ও আত্নসংবরণ দরকার, সেগুলোর ওপর আমরা মনোসংযোগ আর করতে পারিনা। মূলত মানুষকে সহজেই জানা যায় বাজে কাজ ও বাজে কথায়। খারাপ মানুষের মূল চরিত্র তাদের

বাজে কথায়ও জানা হয়ে যায়। কারণ, আপনি-আমি সকলেই নিজেকে প্রকাশ করি কথা ও কাজে। সেটা ভালো কথাতেও হতে পারে এবং ভালো কাজেও হতে পারে। আবার খারাপ কথা ও খারাপ কাজেও হতে পারে। আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে যেন বাজে কথা ও বাজে কাজের কোন শক্তি রেখে না যাই। আমরা যেন আমাদের ঘর-সংসারে, সমাজ ও রাষ্ট্রে ভালো কাজে আসক্তি বাড়িয়ে চলি। সেই সাথে মন্দ কাজের প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে চলি।

“Where words come out from the depth of truth; Where tireless striving stretches its arms towards perfection.”

— Rabindranath Tagore

লেখক: রাজু আহমেদ মোবারক, কলামিস্ট, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর