ওসমান হাদি আর নেই

সময়: 5:16 pm - December 18, 2025 |

মানব কথা: সাত দিন ধরে ডাক্তারদের প্রাণান্ত চেষ্টায়ও ফেরানো গেল না শরীফ ওসমান হাদিকে। গত শুক্রবার সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী ওসমান হাদি। আজ বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৩০ মিনিটের কিছু সময় পর তার মৃত্যুর খবর আসে।

দুর্বৃত্তদের গুলিতে আহত হাদি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

আজ রাতে ওসমান হাদির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও ইনকিলাব মঞ্চের ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ওই পোস্টে বলা হয়, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের মোকাবিলায় মহান বিপ্লবী ওসমান হাদিকে আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন।’

আগামীকাল তার মরদেহ দেশে আনা হবে। হাদির মৃত্যুতে বিএনপি ও এনসিপি শোক জানিয়েছে।

গত ১২ ডিসেম্বর গণসংযোগের জন্য রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গেলে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে গুলি করা হয়। গুলিটি তার মাথায় লাগে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়।

গতকাল রাতেই প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, ওসমান হাদির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে জানা গেছে, হামলার আগে কয়েক মাস ধরে হাদির নিয়মিত চলাচল, বাসা ও অফিসের রুট এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর নজরদারি চালানো হচ্ছিল। দীর্ঘ পরিকল্পনার নেপথ্যে কারা জড়িত এবং কার স্বার্থে এ হামলা তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

তদন্তে আরও উঠে এসেছে, গুলিবর্ষণের পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান ওরফে রাহুল আগারগাঁওয়ে তার বোনের বাসায় আশ্রয় নেন। পরে শুটার ফয়সাল ও মোটরসাইকেল চালক আলমগীর শেখ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, তারা বর্তমানে প্রতিবেশী দেশে অবস্থান করছেন।

র‌্যাব ও ডিবির যৌথ তদন্তে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) আগারগাঁওয়ের কর্নেল গলিতে একটি বাসার নিচ থেকে দুটি ম্যাগাজিন ও ১১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। পরে নরসিংদী থেকে আরও পাঁচটি অস্ত্র ও ৪১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় পল্টন থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা করেন ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের। মামলাটি তদন্ত করছে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত

ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জানান, গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কার কী ভূমিকা ছিল এবং নেপথ্যে কারা জড়িত সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এ পর্যন্ত র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বিভিন্ন মেয়াদে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তদন্ত চলমান রয়েছে।

ওসমান হাদিকে দিনে-দুপরে গুলি করে হত্যাচেষ্টার এই ঘটনার পরপরই দেশে ব্যাপক উদ্বেগ তৈরি হয়। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘটনাটিকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে। অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নির্বাচনের পথে গুপ্ত হামলা, নাশকতা বাড়তে পারে।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক মাস আগেই হত্যার হুমকি পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। গত নভেম্বরে নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছিলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাঁকে ফোন ও মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকেরা তাঁকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখছে। তবে জীবননাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ‘ইনসাফের লড়াই’ থেকে পিছিয়ে যাবেন না।

ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে আসা শরিফ ওসমান হাদিকে শুরুতে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখা যায়নি। মাদ্রাসার শিক্ষক বাবার সন্তান হাদি নেছারাবাদ কামিল মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে আলোচনায় আসেন হাদি। ইনকিলাব মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবিতে শাহবাগে ধারাবাহিক সমাবেশ আয়োজন করেন হাদি। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শোতেও নিয়মিত আমন্ত্রণ পেতে থাকেন। প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হলেও পরে আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। দ্রুত তাঁর একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেন তিনি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতেও ছিলেন সরব। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষেও প্রকাশ্যে মত দেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি।

জুলাই অভ্যুত্থানের পর হাদি জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিলেও পরে নতুন দল এনসিপিতে যোগ দেননি। বরং ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েক মাস ধরে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়া, বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচার, ভোটারদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ ও ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ—সবই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরতেন।

ওসমান হাদিকে হত্যার এই ঘটনাকে নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘পলাতক শক্তির’ সহিংসতার একটা সতর্ক বার্তা হিসেবে দেখছে সরকার।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর