প্লাস্টিক বর্জ্য ও নগরায়ণ সংকটে বাংলাদেশ: অচল নগরজীবন, হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

সময়: 11:51 am - September 22, 2025 |

নিজাম উদ্দিন : বাংলাদেশে নগরায়ণের গতি দ্রুত হলেও এর সাথে তাল মিলিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জসহ বড় শহরগুলো আজ প্লাস্টিক বর্জ্যের দখলে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনসংখ্যার চাপের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু ড্রেন, খাল ও নদী ভরাট করছে না; বরং জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্লাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহ চিত্র: বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৮ লাখ ৭০ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়, বাকিগুলো খোলা পরিবেশে জমা হয়ে থাকে। শুধু রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়।
এই বর্জ্যের বড় অংশই পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, যেগুলো শত বছরেও নষ্ট হয় না।
ড্রেন ও খালে জমা হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে, ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়ক ডুবে যায়।
নদীতে জমা প্লাস্টিক পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে এবং জলজ প্রাণী ধ্বংস করছে।
নগরায়ণের চাপ ও অব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত নগরায়িত দেশ। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৮ শতাংশ শহরে বসবাস করে, আর ২০৫০ সালের মধ্যে তা ৬০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নগর অবকাঠামো ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাড়ছে না।
অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের ফলে খোলা স্থান, খেলার মাঠ ও জলাধার হারিয়ে যাচ্ছে।
শহরের খাল ও নদীগুলো দখল ও বর্জ্যে ভরাট হয়ে অস্তিত্ব হারাচ্ছে।
জলাবদ্ধতা এখন নগরবাসীর নিত্যদিনের সমস্যা।
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকি
প্লাস্টিক বর্জ্য ও নগরায়ণের সংকট একসাথে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
*জনস্বাস্থ্য সমস্যা
ড্রেনে জমে থাকা পানিতে মশার প্রজনন বাড়ছে, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করছে।
প্লাস্টিক গলানোর সময় যে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, তা ফুসফুসজনিত রোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
খাবারের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করে দীর্ঘমেয়াদে কিডনি, লিভার ও স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
*. পরিবেশগত সমস্যা:
নদী-খাল মৃতপ্রায় অবস্থায় চলে যাচ্ছে।
মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ভূমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
সরকারের উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা : সরকার ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সাম্প্রতিক সময়ে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও দুর্বল।
কিছু এলাকায় বর্জ্য আলাদা করার প্রকল্প চালু হলেও তা সারাদেশে পৌঁছায়নি।
নবায়নযোগ্য ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহারে প্রণোদনা খুবই সীমিত।
নগর কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা ও জনবল ঘাটতি রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত বলেন—
“বাংলাদেশের নগরায়ণ এখন পরিকল্পনাহীন। প্লাস্টিক বর্জ্য সমস্যা সমাধান করতে হলে কেবল আইন করে হবে না; জনগণের সচেতনতা, পুনর্ব্যবহার শিল্পে বিনিয়োগ ও টেকসই নগর পরিকল্পনা জরুরি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ড. সেলিম জাহান বলেন—
“প্লাস্টিক শুধু পরিবেশ নয়, সামাজিক সংকটও তৈরি করছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ তারা জলাবদ্ধ ও অপরিকল্পিত বস্তি এলাকায় বসবাস করে।”
আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত:
রুয়ান্ডা ২০০৮ সালেই সব ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করে, আজ দেশটি আফ্রিকার অন্যতম পরিচ্ছন্ন রাষ্ট্র।
ইন্দোনেশিয়া প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে।
ভারত ধাপে ধাপে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।
বাংলাদেশও চাইলে এই উদাহরণগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে।

বাংলাদেশের প্লাস্টিক বর্জ্য ও নগরায়ণ সংকট এখন জাতীয় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যা সমাধান করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর