সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও উপকূলীয় মানুষের ভবিষ্যৎ

নিজাম ঊদ্দিন:
বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার দেশগুলোর একটি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ দ্রুত গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, আগামী কয়েক দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি বর্তমান হারে বাড়তে থাকে, তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল অংশ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। এর ফলে কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষরা ইতোমধ্যেই এই সংকটের সরাসরি শিকার হচ্ছেন। লবণাক্ত পানির কারণে ধান, শাকসবজি বা ডাল চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। জমি অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে, ফলে কৃষকের আয় কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে নদীভাঙন ও বন্যায় প্রতিনিয়ত বসতভিটা হারাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। বহু পরিবার বাধ্য হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা অন্যত্র স্থানান্তরিত হচ্ছেন।
খুলনার পাইকগাছার এক কৃষক জানান, “আগে বছরে দুইবার ধান চাষ করতাম। এখন লবণাক্ত পানি ঢুকে জমিতে কিছুই হয় না। পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।”
বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ইতোমধ্যেই উপকূলীয় অনেক পরিবার গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকাসহ বড় শহরে নতুন করে বসতি গড়ে তুলছেন এসব মানুষ। এতে শহরে জনসংখ্যার চাপ, বস্তি বাড়তি এবং কর্মসংস্থান সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। গবেষকরা সতর্ক করেছেন, যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরে কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে।
কৃষি খাতের পাশাপাশি মৎস্য ও লবণ উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ততার কারণে চিংড়ি চাষ অনেক এলাকায় কমে গেছে, আবার কোথাও কোথাও পানির মান খারাপ হওয়ায় মাছ মারা যাচ্ছে। ফলে মৎস্যজীবীরা লোকসানে পড়ছেন। একই সঙ্গে লবণ উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
উপকূলীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি হলো সুপেয় পানি। লবণাক্ত পানির কারণে পানযোগ্য পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার দূর-দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করছেন, কেউ কেউ বাধ্য হয়ে অনিরাপদ উৎসের পানি ব্যবহার করছেন। এতে ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগসহ নানা পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
সাতক্ষীরার এক গৃহিণী বলেন, “প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়। মেয়েরা পড়াশোনার বদলে পানি আনার কাজে সময় ব্যয় করছে।”
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব শিক্ষা ও কর্মসংস্থানেও পড়ছে। বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে, অনেকেই স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থানের অভাবে মানুষ বিকল্প জীবিকার সন্ধানে বড় শহরে চলে যাচ্ছেন। এতে শহরে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে, নতুন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। উপকূলীয় মানুষকে রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ ও আধুনিকায়ন অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি মিঠাপানি সংরক্ষণের উদ্যোগ বাড়াতে হবে, যাতে মানুষের পানির সংকট কিছুটা হলেও কমে।
এছাড়া জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি যেমন লবণাক্ততা ও খরা সহনশীল ফসলের জাত চাষে কৃষকদের সহায়তা করতে হবে। বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কৃষি ও মৎস্যচাষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মানুষ আয়-রোজগারের অন্য পথ খুঁজে পায়।
বাংলাদেশ একা এই সংকট মোকাবিলা করতে পারবে না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সেই অর্থ ব্যবহার করে উপকূলীয় অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি প্রযুক্তি বিস্তার এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন করতে হবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, “বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই দেশ ভবিষ্যতের বিপর্যয় মোকাবিলা করতে পারবে না।”
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষদের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি, মৎস্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য-সবক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট। এখনই কার্যকর অভিযোজন কৌশল, টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা না পেলে ভবিষ্যতে কোটি কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষ কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎ নয়, গোটা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তাই তাদের বাঁচানো মানে দেশের ভবিষ্যৎকে বাঁচানো।