জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষে এখনও ফ্যাসিবাদের কালো ছায়া (পর্ব-১)
নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ যেন দূর্নীতির আঁখরা। ঘুষ আর দালালা চক্রের হাতে জিম্মি সেবা প্রত্যাশীরা। ঘুষ না দিলে ফাইল যেন নড়েইনা। কর্মকর্তা -কর্মচারী -দালাল সিন্ডিকেট এর জালে আটকে গেছে পুরো প্রতিষ্ঠানটি।
সংস্থাটির এমন অবস্থা যে ঠক বাছতে গা উজাড়। সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নিজেরাই জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির সিন্ডিকেটের সাথে সরাসরি জড়িত। মাঠ পর্যায়ে অফিস সহায়ক, সুইপার, দ্রাইভার, চৌকিদার, সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে কেরানী, ড্রাফটস ম্যান থকে শুরু করে প্রকৌশলী পর্যন্ত এবং সেগন বাগিচায় হেড অফিসের সর্বত্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জমির দালালী করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
চেয়ারমযান আসে চেয়ারমযান যায় কিন্তু এই সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। হয় এই সিন্ডিকেটের কথা মতো নিয়োগ; পদোন্নতি; বরাদ্দ ও অন্যান্য ফাইল সাইন করলে প্লট -ফ্ল্যাট নিয়ে চ্যায়ারে থাকতে পারেন, নতুবা থাকতে পারেন না। এই সিন্ডিকেট পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসন আমলে দূর্নীতির রাম রাজত্ব কায়েম করেছে। পতিত ফ্যাসিস্টদের দোসররা কোন শাস্তিতো পানইনি উল্টো পুরস্কৃত হয়েছেন।
আওয়ামী দুর্বৃত্তরা অনিয়মকে নিয়ম বানিয়ে নিজেরা শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই সিন্ডিকেটের সম্মুখে ছিলেন শেখ সোহেল রানা, যিনি ফ্যাসিবাদের পুরোটা সময় ডি-ফ্যাক্টো চ্যায়ারমেন ছিলেন। তার কথাই শেষ কথা ছিল। গোপালগঞ্জের এই শেখ সোহেল উপসহকারী প্রকৌশলী হিসাবে চাকুরিতে যোগদান করেন। যদিও তার নিয়োগ প্রক্রিয়াটি নিয়েই অনেক প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ার সুবাদে শত দূর্নীতি করেও পেয়েছেন একের পর এক পদোন্নতি। এমনকি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সহকারী প্রকৌশলী হওয়ার আগেই নির্বাহী প্রকৌশলীর চেয়ার বাগিয়ে নিয়েছিলেন। পরে দীর্ঘকাল ঢাকা ডিভিশনে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী থেকে রাম রাজত্ব কায়েম করেন। উন্নয়ন প্রকল্পে নিজে ঠিকাদারী করেন। এছাড়া জমি বেচাকেনা; বদলী বানিজ্য; পদোন্নতি বানিজ্য; ফ্ল্যাট বিক্রিসিন্ডিকেট পুরোটাই ছিলো তার নিয়ন্ত্রনে।
৫ই আগস্ট খুনি হাসিনার পতন হলে শেখ সোহেল কিছুটা বাটে পড়েন। তার বিরুদ্ধে মিরপুরে ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি করে মানুষ হত্যার অভিযোগে মামলা হয়। এই সিন্ডিকেটে শেখ সোহেলের অন্যতম সহযোগী ছিলেন জিয়া। এই জিয়া হিলেন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। কিন্তু কপাল গুনে তিনি এখন নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে খুলনা ডিভিশনে রয়েছেন। যার পুরও নাম জিয়াউর রহমান। জিয়া উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন। একই দিনে লিখিত পরীক্ষা, সেই দিনই লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং সেই দিনই মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে চুড়ান্ত ফল প্রকাশ করে নিয়োগ পত্র প্রদান এর মতো অবিশ্বাস্য দ্রুত্তার সাথে এক মহা বিতর্কিত প্রক্রিয়ায় জিয়ার নিয়োগ। সেই নিয়োগ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও মিডিয়া ও দুদক কে ম্যানেজ করে সব কিছু ধামা চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। ফ্যাসিবাদের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতা সেজে ফুলে ফেপে দেশে বিদেশে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন। থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাড়ে তিন কোটি টাকা বাজার মূল্যের ফ্ল্যাটে । এছাড়াও স্ত্রী র নামে আরো ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। রাজধানীর বসিলায় ২৫ কাঠা জমি; পূর্বাচলে ১৮ নম্বর সেক্টরে ৫ কাঠার প্লট; উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে ৩ কাঠার প্লট, উত্তর খানে ৫ কাঠা জায়গার উপর ১০ তলা বাড়ি; নিজের গ্রামের বাড়িতে প্রাসাদোপম বাংলো বাড়ি নির্মান করেছেন। নিজের সন্তান কে নামকরা ইংলিশ নিডিয়াম স্কুলে; বেসরকারি বিস্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। নিজে শেয়ারে হেরিয়ার গাড়ির শোরুম দিয়েছেন। এই দুর্মূল্যের বাজারে সরকারি চাকুরিজীবিদের সংসার চালাতেই হিমশিম খায় বলে সরকার বিভিন্ন সময়ে মহার্ঘ ভাতা প্রদান করেন। সেখানে কিভাবে এই দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এত বিলাসি জীবন যাপন করেন, তা আমাদের বোধ গম্য নয়। তবে কি তিনি আরব্য রজনীর সেই আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন? ফ্যাসিবাদের সময়ে তিনি ইলিয়াস মোল্লার লোক ছিলেন। ইলিয়াস মোল্লা ও কামাল মজুমদার এর ছত্র ছায়ায় ভুমিদস্যুতা করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই দালাল চক্রের আরেক সিন্ডিকেট সদস্য মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য সুফিয়া খাতুনের সাথে মিলে ফ্ল্যাট বেচা কেনা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করতেন। এই সুফিয়া জুলাই আগষ্ট বিপ্লবে মিরপুরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুন্ডাদের নিয়ে নিরীহ জনতার মিছিলে এলোপাথারি গুলি করে মানুষ হত্যা করেন। ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ এ আকরাম খান রাব্বি নামে একজন কে আওয়ামীলীগের অঙ্গ সংগঠনের কর্মীদের ছোড়া গুলিতে হত্যার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সুফিয়া খাতুনকে ৩০ নভেম্বর ২০২৪ গ্রেফতার করে পুলিশ। এই সুফিয়া খাতুন গ্রেফতারের সূত্র ধরে উপসহকারী প্রকৌশলী রাদিউজ্জামান গ্রেফতার হলে ছাত্র গনহত্যায় অর্থের জোগান দাতা এই সিণ্ডিকেটের বুকে কাপন ধরে যায়। এই সুফিয়া খাতুনের সাথে জিয়ার সখ্যতা বহু পুরানো ও পরীক্ষিত, যা তাদের কল লিস্ট ও হোয়াটস এপ ট্র্যাক করলেই বেরিয়ে আসবে। মহাম্মদপুরে এসে জিয়া ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর এজেন্ট জাহাংগীর কবির নানক এর লোক হয়ে উঠেন। তাছাড়া সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজকে বিভিন্ন সমইয়ে প্লট পাইয়ে দেয়ায় জোসেফ বাহিনীর সাথেও তার সখ্যতা রয়েছে।
মোহাম্মদপুরে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের নেক্সাসকে তিনি অর্থ সাহায্য দিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। জিয়ার দূর্নীতি তদন্তে ৫/১১/২০২৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখে দুদকে সহকারী পরিচালক (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২) এস, এম রাশেদুল হাসান স্বাক্ষরিত ০০.০১,০০০০,৫০২,০৩,০০৬,২০/৪২২২৫ স্মারকে তথ্য চেয়ে তাগিদ পত্র দেয়া হয়েছে। সেই স্মারকে জিয়ার ব্যক্তিগত নথি; সার্ভিস বহি এবং তার পদোন্নতি সংক্রান্ত সকল রেজুলেশন; গ্রেডেশন লিস্ট/ জেষ্ঠতার তালিকা; জাগৃকের পদোন্নতি সংক্রান্ত নীতিমালার সত্যায়িত ফটোকপি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু দেড় মাস অতিক্রান্ত হলেও দুদক্কে থোড়াই কেয়ার করে জাগৃক কোন তথ্য সরবরাহ করে নি। আমরা খোজ নিয়ে জানতে পেরেছি দুজন মেম্বার জিয়া কে বাচাতে মরিয়া। এদের একজন সদস্য প্রকৌশল জনাব মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। অপরজন সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কাজী আতিয়ুর রহমান। জিয়ার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে দূর্নীতির অভিযোগ গুলোকে আমলে না নিয়ে উল্টো একের পর এক পদোন্নতি সহ প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে গেছেন কাজী আতিয়ুর রহমান। গত সেপ্টেম্বরে জিয়ার পদোন্নতির সময়ে জনপ্রতি ২ কোটি টাকা ঘুষ লেন দেন হয়েছে মর্মে হাউজিং এ জন শ্রুতি রয়েছে। তাছাড়া সদস্য কাজী আতিয়ুর সম্প্রতি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বদলী এবং কর্মচারী ইউনিয়নের যোগসাজসে ঢালাউ বদলী বানিজ্য করে ৬০ কোটি টাকা কামিয়েছেন। তিনি কুষ্টিয়া বাড়ি হওয়ার সুবাদে মাহাবুবুল আলম হানিফ এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। মাহাবুবুল আলম হানিফ এসিউর প্রপার্টিজের মালিক বিধায় হাউজিং এর জমি দখলের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজী আতিয়ুর কে এখনে বসান। আতিয়ুর আওয়ামী ঘরানার অফিসারদের সুরক্ষা দিয়ে এশিউর ডেভেলপমেন্ট সহ ভুমি দস্যুদের স্বার্থ সুরক্ষায় মরিয়া। তিনি উন্নয়ন প্রকপ্লের অর্থ ছাড় করন সহ যে কোন ফান্ড ছাড়তে ভোগান্তি দিয়ে ২ পার্সেন্ট টাকা আদায় করে নেন। তাকে ২ % টাকা না দিলে মাসের পর মাস ফাইল পড়ে থাকে, তার আস্কারায় কেরানিরা ফাইল ফেলে রাখে। তিনি এসব সহকারি পরিচালক, কেরানিদের গডফাদার। তার এই স্বেচ্ছাচারিতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে গোটা জাগৃক। তিনি নিজে ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। কর্মজীবনে মুজিব্বাদী আদর্শ বুকে ধারন করে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। ফ্যাসিবাদী হাসিনার আমলে সাবেক পূর্ত সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকারের কেশিয়ার খ্যাত এই কর্মকর্তা তার শিশ্যদের নিয়ে এখনও লূটপাটতন্ত্র কায়েম রেখেছেন। ফলে আগস্ট বিপ্লবের যে স্পিরিট তা বাধা গ্রস্ত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর এই বাংলাদেশে খুনি হাসিনার ল্যাস্পেন্সারদের এই উগ্র আস্ফালন আর বিদেশে টাকা পাচার আমরা আর দেখতে চাইনা। অচিরেই এই দুস্কৃতিকারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আইনের আওতায় আনা এবং দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি প্রদান এখন সময়ের দাবি।