কাঁচামালের অভাবে বন্ধ দেশবন্ধু সুগার মিল

সময়: 8:17 am - January 21, 2025 |

মানব কথা: কাঁচামালের (র-সুগার) অভাবে প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপের সুগার রিফাইনারি মিলস লিমিটেড। কতিপয় কয়েকটি ব্যাংকের অসহযোগিতায় ঋণ পত্র (এলসি) খুলতে বেশ জটিলতায় পড়েছে কোম্পানিটি। শিগগিরই এলসি না পেলে একই সঙ্গে কারখানা চালু করতে না পারলে চিনিতে বিশাল সংকটে পড়বে দেশ। এমনকি আগামী রমজান মাসে দ্বিগুণ চাহিদার যোগানে বেশ ঝামেলায় পড়বে সরকার। শুধু তাই নয় চিনির দামও তখন কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন খাত বিশেষজ্ঞরা।
এমতাবস্থায় এলসি জটিলতা কাটাতে ব্যাংকের সহযোগিতা ও সরকারের সহায়তা পেলে আসন্ন রোজার আগে সুগার মিল চালু ও উৎপাদনে যেতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে রমজানে চিনির বাজার স্বাভাবিক রাখতে ভূমিকা রাখতে পারবে কোম্পানিটি। সম্প্রতি নরসিংদীর পলাশে অবস্থিত দেশবন্ধু গ্রুপের সুগার মিলসসহ দেশবন্ধু গ্রুপের কয়েকটি কারখানা পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব কথা জানান।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু দেশবন্ধু গ্রুপ নয়, বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স না থাকায় অনেক ব্যাংক মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ইস্যু করছে না। শুল্ক নীতিমালার কারণে স্থানীয় বন্ডেড লাইসেন্সধারীদের কাছ থেকে সুতা, কাপড় বা অ্যাক্সেসরিজ ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির আওতায় বাকিতে কেনা যাচ্ছে না। এমনকি নগদ অর্থে এসব পণ্য কিনতে গিয়ে উদ্যোক্তাদের বেশি খরচ করতে হচ্ছে, যা কার্যকরী মূলধনে চাপ বাড়িয়ে লাভ কমিয়ে দিচ্ছে।
দেশবন্ধু গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকিং জটিলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে অপরিশোধিত, পরিশোধিত চিনি আমদানি করতে পারছে না। যে কারণে সুগার রিফাইনারি বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হয়েছেন তারা। তাদের দাবি, এভাবে উৎপাদন বন্ধের কারণে বাজারে চিনির ঘাটতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির বড় অঙ্কের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। একই সঙ্গে বেকার হচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। দেশবন্ধু গ্রুপের সুগার মিলে প্রতি বছর তিন লাখ টনের মতো চিনি প্রক্রিয়াজাত করে। প্রতিষ্ঠানটি চাহিদার ১৫ শতাংশ চিনি সরবরাহ করে থাকে। আসন্ন রোজায় চিনি সরবরাহ ও দাম ঠিক রাখতে কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকের এলসি (ঋণপত্র) জটিলতা নিরসন করতে দ্রুত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি নরসিংদীর পলাশে উপস্থিত দেশবন্ধু গ্রুপের কারখানা পরিদর্শন করে দেখা যায়, সুগার মিল পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও বোতলজাত পানি, বিভিন্ন ধরনের কোল্ড ড্রিং, কোল্ড ড্রিংসের বোতল উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, কারখানার যেসব ইউনিট চালু আছে তার উৎপাদন ক্ষমতা এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। আগে যেখানে ১০ টন পণ্য উৎপাদন হতো এখন কাঁচামালের অভাবে সেখানে ৩ থেকে ৪ টন উৎপাদন হচ্ছে। সুগার রিফাইনারি বন্ধ থাকায় প্রতিষ্ঠানটি অন্য কোম্পানি থেকে চিনি এনে কোল্ড ড্রিংকস উৎপাদন করছে। প্লাস্টিকের কাঁচামাল আমদানি করতে না পেরে সেটাও স্থানীয় একটি কোম্পানি থেকে কিনে কারখানা চালু রেখেছে।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ২০১৯ সাল থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ২০১৭ সাল থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত দেশবন্ধু গ্রুপের সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট তিন হাজার ৯৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। এর বিপরীতে পরিশোধ করেছে তিন হাজার ৬০৫ দশমিক ৭৩ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে গ্রুপের পাঁচটি কোম্পানির অনুকূলে মোট এক হাজার ৫৪৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা ঋণ নেয়; দেশবন্ধু গ্রুপ পরিশোধ করে এক হাজার ১৪৬ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। একইভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৫৩ কোটি ৭০ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে; এর মধ্যে শোধ করেছে ৩৮০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
দেশবন্ধু গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, তিনটি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া ঋণের বেশিরভাগ পরিশোধ করা হলেও কিছু অর্থ বকেয়া আছে, যে কারণে তারা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে পণ্যের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে খেলাপি হওয়া ঋণগুলো পুনঃতফসিল করতে চাইলেও ব্যাংক সে সুযোগ দিচ্ছে না। এছাড়া তাদের সাপ্লাইয়ার ক্রেডিট কন্ট্রাক্টের আওতায়ও কাঁচামাল আমদানি করতে সহায়তা করছে না ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রুপ সিএফও বশির আহমেদ বলেন, তৎকালীন সরকার উচ্চমূল্যে সুগার আমদানি করে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করে। তখন কোম্পানির ৩৭৮ কোটি টাকা লোকসান হয়। এই লোকসানের টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও সরকার তা দেয়নি। যার কারণে গ্রুপের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো দেশবন্ধু গ্রুপের কাছে ঋণের কিছু টাকা পাবে এটি সত্য, তবে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধও করা হচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের এই মহাসংকটের কালে ঋণ পরিশোধে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানই এ সমস্যায় পড়েছে। ব্যাংকগুলো অন্য অনেকের সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্য ঋণ রি-শিডিউল সুবিধা দিলেও আমাদের সে সুযোগ দিচ্ছে না। যদিও আমরা সব ধরনের নিয়ম কানুন মেনেই রি-শিডিউলের আবেদন করেছি। কেন দিচ্ছে না সে বিষয়েও ব্যাংকগুলো কোনো ব্যাখ্যা আমাদের জানায় না।
সাবেক সচিব ও দেশবন্ধু গ্রুপের নিবার্হী পরিচালক (ইডি) মোমতাজুল ইসলাম বলেন, পবিত্র মাহে রমজান মাস আমাদের হাতসানি দিচ্ছে। রমজান মাসেই চিনির চাহিদা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। সে সময় আমরা যদি চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চাই তাহলে এখনই আমাদের সুগার আমদানির বিকল্প নেই। এর জন্য কাঁচামাল আমদানি করতে এলসির খুব দরকার। আর এই এলসি পেতে ব্যাংকের সহযোগিতা জরুরি। তাই এ সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের সহযোগিতা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য ও পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এখন ব্যাংক কোন গ্রাহকের সঙ্গে ব্যবসা করবে এটা তাদের নিজস্ব বিষয়। তবে নিয়মনীতি মানার পরও যদি কারও এলসি খোলার সমস্যা হয়, এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি দেখবে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দেশবন্ধু গ্রুপের পরিচালক (অপারেশন, প্রশাসন, এইচআর ও কমপ্লায়েন্ট) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাকির হোসেন জানান, এলসি জটিলতায় কাঁচামাল আমদানি করতে পরছি না। যার কারণে চিনির কারখানা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। পলিমার, ড্রিংকসসহ অন্য কারখানাগুলোর উৎপাদনও দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কম করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে নিয়ম মেনে ব্যাংক যদি আমাদের সহযোগিতা না করে তাহলে আমাদের দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ যেমন হুমকিতে পড়বে তেমনি, কয়েক হাজার মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারাবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মাথাব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলা কোনো সমাধান হতে পারে না। যারা অনিয়ম করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু এ জন্য প্রকৃত ব্যবসায়ীদের পথে বাধা সৃষ্টি করা উচিত নয়।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে চিনির মিলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন সালমান তারেক। দীর্ঘ দুই মাস কারখানা বন্ধু থাকায় অলস জীবন কাটাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, কাজ ছাড়া দেশবন্ধু গ্রুপ বেতন দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা কতোদিন দেবে এটা দেখার বিষয়। তাছাড়া কাজ ছাড়া বেতন নেওয়াটাও নিজের কাছে কেমন যেনো লাগে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন আরো কয়েকজন শ্রমিক। এলসি খোলার সুযোগ দিয়ে কারখানা চালু রাখার দাবিতে তারা বিক্ষোভ করেছেন। শ্রমিকরা হুঁশিয়ার করে বলেছেন, দ্রুত কারখানা খোলার ব্যবস্থা না করলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। শ্রমিকরা আরো জানান, ব্যাংকের এলসি বন্ধ থাকার কারণে এখন আমাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর