মেজর সিনহা হত্যা : প্রদীপ- লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড আপিলেও বহাল

মানব কথা: সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় প্রধান দুই আসামি সাবেক ওসি প্রদীপ কুমাার দাশ ও পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিলের রায় প্রদান করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বাকি ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশও বহাল রাখা হয়েছে।
সোমবার (২ জুন) বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।
গত ২১ এপ্রিল প্রধান বিচারপতির নির্দেশে মামলাটি দ্রত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের এই বেঞ্চ নির্ধারণ করা হয়। এরপর ২৩ এপ্রিল থেকে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের শুনানি শুরু হয়। গত ২৯ মে আপিল শুনানি শেষে ২ জুন রায়ের জন্য দিন ধার্য করা হয়।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
পরের দিন ১ আগস্ট এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় ২ টি এবং রামু থানায় ১ টি মামলা দায়ের করেন। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে এই মামলা দুইটি দায়ের হয়। টেকনাফ থানায় দায়ের করা এই দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। এছাড়া রামু থানায় মাদক আইনে দায়ের করা মামলাটিতে আসামি করা নিহত সিনহার অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয় টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। মামলার অন্য আসামিরা হল, টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপ-পরির্দশক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভূক্ত করার পর আদালত তদন্তভার দেন র্যাবকে। একই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটিও র্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত।
২০২০ সালের ৬ আগস্ট সকালে মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভূক্ত করে তদন্তের জন্য র্যাবকে হস্তান্তর করা হয়। ওইদিন বিকালে মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওইদিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা নামের কোন পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে কর্মরত ছিল না। ওইদিনই আত্মসমর্পণকারি আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
র্যাব মামলার তদন্তকালীন ২০২০ সালের ১১ আগস্ট গ্রেপ্তার করে পুলিশের দায়ের মামলার তিন সাক্ষি টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে আদালতে সোপর্দ করেন। ওইদিনই তাদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারি কর্মকর্তা।
মামলা তদন্তের এক পর্যায়ে ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এপিবিএন এর তিন সদস্য সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে র্যাব আদালতে সোপর্দ করে। ওইদিনই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ড আবেদন করেন।
২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর র্যাব কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ওইদিনই রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা।
কারাগারে থাকা এই ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারি কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব-১৩ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জেষ্ঠ্য সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিল। অভিযোগপত্রে সাক্ষি করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের দায়ের করা মামলা ৩ টির চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব এর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। সেই সাথে পুলিশের দায়ের ৩ টি মামলার চুড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন আদালত। এরপর মামলাটি জেষ্ঠ্য বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ এর আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন এর আদালতে বদলী হয়।এরপর ২০২১ সালের ২৪ জুন পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এতে আদালত ওইদিনই তাকে কারাগারে প্রেরণ করার আদেশ দেন।
২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। সেই সাথে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। এরপর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারী কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেন। সবশেষে ২০২২ সালের ৯ থেকে ১২ জানুয়ারী পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে আদালত ৩১ জানুয়ারী মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
৩১ জানুয়ারি ২০২২ সালে বিকালে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার মোট ১৫ আসামির দুই জনকে মৃত্যুদণ্ড, ছয় জনকে যাবজ্জীবন ও সাত জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন হলেন, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক লিয়াকত আলী। তাদের ফাঁসিতে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে বলেছেন বিচারক।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দীন। মামলা থেকে খালাস পাওয়া সাত জন হলেন, এপিবিএনের এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল মো. রাজীব, মো. আব্দুল্লাহ, পুলিশের কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, লিটন মিয়া ও আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এছাড়া মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। গঠিত কমিটি তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে কি ধরণের বিষয়বস্তু উল্লেখিত ছিল তা প্রকাশ পায়নি। একই ইস্যুতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ একযোগে দেড় সহস্রোধিক পুলিশ সদস্যকে অন্যত্রে বদলী করে তদস্থলে নতুন পুলিশ সদস্যদের পদায়ন করা হয়েছিল।
এ মামলার রায় হওয়ার পর আদালতের সকল প্রকার কাগজ-পত্র উচ্চ আদালতে প্রেরণ করা হলেও রাষ্ট্রপক্ষ কোন আপিল করেননি। তবে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের পক্ষে হাইকোর্টে দুই আপিল করা হয়েছিল ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি।