নারী উন্নয়ন ও মানবসম্পদ গঠনে বিএনপির ঐতিহাসিক অবদান

সময়: 12:05 pm - September 2, 2025 |

বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ইতিহাস গভীরভাবে যুক্ত বিএনপির নেতৃত্বের সাহসী পদক্ষেপের সঙ্গে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত সংস্কার, বেগম খালেদা জিয়ার যুগান্তকারী কর্মসূচি এবং বর্তমান বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি সব মিলেই গড়ে তুলেছে এক দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে নারীর ক্ষমতায়নকে জাতীয় উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধরা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৩০-এ উন্নীত করে তিনি নারীদের জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছিলেন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে তিনি ১৯৭৬ সালের স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ প্রবর্তন করেন, যার মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন চালু হয়। এর ফলে নারীরা সরাসরি স্থানীয় প্রশাসন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এই সংস্কার নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।

অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে স্বাক্ষরিত দেশ-দাইউ চুক্তি বাংলাদেশের প্রস্তুত তৈরি পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু করেছিল। এই শিল্প এখন দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি খাত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। বর্তমানে এই খাতে কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ নারী। গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা এখন পোশাক কারখানায় কাজ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে, দারিদ্র্যের চক্র ভেঙে নিজের পরিবার ও সমাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছে।

বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির প্রথম সরকার (১৯৯১-১৯৯৬) নারীর শিক্ষায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। ১৯৯৪ সালে চালু হওয়া নারী মাধ্যমিক শিক্ষা ভাতা কর্মসূচি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, যা গ্রামীণ মেয়েদের জন্য নবম ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা নিশ্চিত করেছিল। এই কর্মসূচি মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারীÑ বাল্যবিবাহ কমেছে, প্রজনন হার হ্রাস পেয়েছে, দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। একই সঙ্গে ১৯৯৩ সালে শুরু হওয়া ফুড ফর এডুকেশন কর্মসূচি দরিদ্র পরিবারগুলোকে খাদ্য প্রণোদনা দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিল। পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালে এই কর্মসূচিকে নগদ অর্থভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষা ভাতা কর্মসূচিতে রূপান্তর করা হয়, যা এখনও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে।

বিএনপির দ্বিতীয় সরকার (২০০১-২০০৬) নারীর স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং পরিবার পরিকল্পনায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করে। ২০০৩ সালে চালু হয় হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রাম, যেখানে ৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা সম্প্রসারণ করা হয়। একই সময়ে ন্যাশনাল নিউট্রিশন প্রোগ্রাম চালু করে বিএনপি পুষ্টিসেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে একীভূত করে, যার ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার দ্রুত হ্রাস পায়, অপুষ্টি কমে আসে এবং নারীদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।

এই ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে আরও এগিয়ে নিতে তারেক রহমানের ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি এক নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে। কর্মসূচির কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য হলো- নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি, শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্প্রসারণ। মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ও ভাতা কর্মসূচিকে আরও সম্প্রসারণ, বাজারকেন্দ্রিক কারিগরি ও ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়ন, মাতৃস্বাস্থ্য ও পুষ্টিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে এই কর্মসূচি নারীর ক্ষমতায়নকে জাতীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্রথম ১৮ মাসে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির, যেখানে নারীদের উচ্চমূল্য সংযোজনমূলক খাতে যুক্ত করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে।

শহীদ জিয়াউর রহমানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, বেগম খালেদা জিয়ার শিক্ষাবিপ্লব ও স্বাস্থ্য বিনিয়োগ, এবং তারেক রহমানের ভবিষ্যৎগামী কৌশল- সব মিলে বিএনপির ঐতিহ্য নারীর জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। মেয়েদের বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বেড়েছে, বাল্যবিবাহ কমেছে, কর্মসংস্থান বেড়েছে, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস পেয়েছে এবং নারী আজ দেশের উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। আজ যখন বাংলাদেশ উন্নত অর্থনীতির পথে এগোতে চায়, তখন নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে আরও বিনিয়োগ করা জরুরি। তারেক রহমানের ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি সেই প্রতিশ্রুতিই বহন করে- যেখানে নারী ও পুরুষ সমানভাবে অংশীদার হয়ে গড়ে তুলবে একটি সমৃদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ।

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং সাবেক বিশ্ব ব্যাংক সিনিয়র কর্মকর্তা

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর