বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে তাড়াহুড়ো করছে পাকিস্তান

মানব কথা: পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার সম্প্রতি ঢাকা সফর করেছেন। প্রায় ১৩ বছর পর এমন উচ্চপর্যায়ের কোনো পাকিস্তানি দায়িত্বশীল ব্যক্তির বাংলাদেশ সফর এটি। শেখ হাসিনার পতনের পর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে দ্রুত বদল আনতে চাইছে পাকিস্তান। বাংলাদেশে ১৩ বছর পর শীর্ষ পর্যায়ের সফরে এসে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের ঘোষণা দিয়ে গেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়।
মূলত হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে কূটনৈতিক সুযোগ দেখছে ইসলামাবাদ। এমন অবস্থায় বাণিজ্য ও কূটনীতিতে এগোচ্ছে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে ইসহাক দার এ সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ উল্লেখ করে বলেন, এটি দুই দেশের পুনর্জাগরিত অংশীদারিত্বের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তার কথায়, আমাদের কাজ করতে হবে এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে, যেখানে করাচি থেকে চট্টগ্রাম, কোয়েটা থেকে রাজশাহী, পেশোয়ার থেকে সিলেট এবং লাহোর থেকে ঢাকা, সব তরুণরা একসঙ্গে কাজ করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে এবং যৌথ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।
তার এ সফর মূলত মাসের পর মাস ধরে চলা কূটনৈতিক ও সামরিক যোগাযোগের পর বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষত, ২০২৪ সালের আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠেছে। হাসিনা ভারতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বর্তমানে ভারতে পালিয়ে আছেন।
তবে পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক মাসুদ খালিদ সতর্ক করে বলেন, অতীত এখনো দুই দেশের আস্থা তৈরিতে বাধা হয়ে আছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তানের উদ্যোগে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে যাতে সম্পর্কের পথে কৃত্রিম বাধাগুলো এখন দূর হয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক গভীর করতে হলে গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার একটি কাঠামো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। বিশ্লেষকরা এত দ্রুত সম্পর্ক উষ্ণ হয়ে উঠবে, তা ধারণা করেননি।
এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান ইসলামাবাদে গিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর ফেব্রুয়ারিতে যান বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান। এরপর এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বেলুচ ঢাকায় আসেন।
এরপর মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের চার দিনের সংঘাতের কারণে ইসহাক দারের সফর পিছিয়ে যায়। তবে জুলাইয়ে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি ঢাকা সফর করেন। অবশেষে আগস্টে দার ঢাকায় এলেন, একই সময়ে পাকিস্তানে যান বাংলাদেশের কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান। সেখানে তিনি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফস কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সঙ্গে বৈঠক করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন মনে করেন, পাকিস্তানের এই তড়িঘড়ি কৌশলগত। তিনি বলেন, হাসিনা সরকারের আমলেও পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়েছে। এখন তারা ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ের মতো সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ দেখছে।
তিনি মনে করিয়ে দেন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা জিয়াউর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিলেন। তবে বাংলাদেশে শাসন পরিবর্তন প্রায়ই ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি করেছে। পাকিস্তান হয়তো বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনকেও কাজে লাগাতে চাইছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এখনো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে গভীর ছায়া ফেলছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী বাহিনীর হাতে লাখো বাঙালি নিহত হয়, প্রায় দুই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হন।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরী মনে করেন, ভারতীয় আঞ্চলিক আধিপত্য মোকাবিলায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এক হতে হবে। গত মে মাসে কাশ্মীরে হামলার পর ভারত-পাকিস্তানের চার দিনের আকাশযুদ্ধে এই বিরোধ আবার প্রকট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান মনে করেন, ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্ক এখন কিছুটা শীতল হলেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। তিনি বলেন, পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত অর্থনীতিনির্ভর। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক কেবল নিরাপত্তা বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অর্থনীতির ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে।
চীন বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বাড়াচ্ছে। বেইজিং পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও হাসিনা সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পরও চীন তার অবস্থান ধরে রেখেছে। মার্চে ইউনূস বেইজিং সফর করেন। আগস্টে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক সপ্তাহের সফরে যান চীনে।
বাংলাদেশ ১২টি চীনা জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার বিষয় বিবেচনা করছে। পাকিস্তান ইতোমধ্যে এসব যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বও গভীর। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব কারণে ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে।
দারের দুই দিনের সফরে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে শীর্ষ ভূমিকা রাখা ছাত্রনেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টিও (এনসিপি) ছিল।
পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক আবদুল বাসিত বলেন, বাংলাদেশে ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচন হবে, তার আগে এসব বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। অতীতের সমস্যাগুলো দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে হবে।
অর্থনীতিতেও উভয় দেশ উপকৃত হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে, পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি মাত্র ২.৫ শতাংশ। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও এখনো সীমিত। ২০২৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশে ৬৬১ মিলিয়ন ডলার পণ্য রপ্তানি করেছে, বিপরীতে আমদানি মাত্র ৫৭ মিলিয়ন ডলার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিলওয়ার হোসেন বলেন, পাকিস্তান থেকে তুলা, টেক্সটাইল, চাল, সিমেন্ট, ফল ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আমদানি করতে পারে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, পাকিস্তান আমদানি করতে পারে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য, কেমিক্যাল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও তামাকজাত দ্রব্য।
তিনি উল্লেখ করেন, দুই দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা ৪৩০ মিলিয়ন, যা পশ্চিম ইউরোপের দ্বিগুণেরও বেশি।
তবে ১৯৭১-এর ক্ষত এখনো বড় বাধা। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে এখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা চায়। এছাড়া, বাংলাদেশে বসবাসরত দুই লাখেরও বেশি উর্দুভাষী মুসলমানের বিষয়টি অমীমাংসিত। তারা মূলত বিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন, তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়নি এবং পাকিস্তানও তাদের নিতে অনিচ্ছুক।
এছাড়া, মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভাগাভাগি এবং ১৯৭০ সালের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ঘোষিত সাহায্যও এখনো বিতর্কের বিষয়।
তবুও পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরী বলেন, দুই দেশের জনগণ পুনর্মিলনের পক্ষে। ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের মানুষও সমানভাবে দুঃখিত। এখন সবাই সামনে এগিয়ে যেতে চায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিলওয়ার হোসেন বলেন, হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলেও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে বাংলাদেশের জনমত অপরিবর্তিত। অতীত ভুলে থাকা সম্ভব নয়, তবে কূটনীতি সবসময়ই গতিশীল। দুই দেশ অর্থনীতি, কূটনীতি ও সংস্কৃতিতে সহযোগিতা বাড়াতে পারে, পাশাপাশি অতীতের ক্ষত নিরাময়ের প্রক্রিয়াও চালিয়ে যেতে পারে।