সাগরে বেশি ইলিশ মিললেও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে

সময়: 8:09 am - October 5, 2024 |

মোহাম্মদ খোরশেদ হেলালী, কক্সবাজার প্রতিনিধি: ট্রলার ভর্তি ইলিশ মাছ নিয়ে সাগর থেকে ফিরছেন কক্সবাজার উপকূলের জেলেরা। বিশেষ করে জেলা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ট্রলারে করে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ নিয়ে ফিরছেন জেলেরা । কিন্তু এসব ইলিশের দাম আকাশচুম্বী, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ইলিশ । সাগরে ব্যাপক হারে ইলিশ ধরা পড়লেও নিম্ন আয়ের লোকজন ইলিশ মাছ কিনতে পারছেনা। তাই এখন এই ইলিশ বিলাসী পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

কক্সবাজার জেলা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, গত সেপ্টেম্বর মাসে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ হয়েছিল ৬৯৮ টন ৭৪ কেজি । তার মধ্যে ইলিশ রয়েছে ১৭২ টন ২৮৫ কেজি।

মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) সকালে কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় , ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ নিয়ে ঘাটে ভিড়েছে অন্তত ১০০ টির বেশি ট্রলার। প্রতিটি ট্রলারে আছে ১ হাজার থেকে ২ হাজার ইলিশ মাছ । জেলেরা ট্রলারের ইলিশ ছোট নৌকায় তুলে বাজারে নিয়ে আসছেন।

দেখা যায় মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে কয়েকটি বিশাল স্তূপে অন্তত ১০ থেকে ২০ হাজার ইলিশ থাকতে পারে । বেশির ভাগ ইলিশের ওজন ৭০০-৯০০ গ্রাম। বাজারে ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ (পাইকারি) বিক্রি হয় ৮৫০ টাকা কেজি । অন্যদিকে ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ১০০ টাকা, ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং ১ কেজির বড় ইলিশ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ২ হাজার টাকায়।

সকালে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ১ হাজার ২০০টি ইলিশ বিক্রি করে প্রায় ১১ লাখ টাকা পেয়েছেন এফবি খাজা নামে একটি ট্রলারের জেলে । ট্রলারটির মালিক নুরুল হক কোম্পানি বলেন, ২১ জন জেলে নিয়ে ১০ দিন আগে ট্রলারটি ৬০ কিলোমিটার দূরে জাল ফেলে। প্রথম দুই দিন ইলিশ ধরা পড়েছে খুবই কম। এরপর আরও ১০-১৫ কিলোমিটার গভীরে গিয়ে জাল ফেললে ৭০০ ইলিশ ধরা পড়ে। আরও গভীর সাগরে জাল ফেলা হলে ইলিশ আরও বেশি ধরা পড়ত।

সম্প্রতি বৈরী আবহাওয়া এবং ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকার পর জেলেরা সাগরে মৎস্য আহরণে নামতে পারেনি। তাই দীর্ঘদিন কোলাহল মুক্ত ছিল কক্সবাজার মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। গত দেড় মাস ধরে জেলেরা বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে সাগর থেকে জাল ফেলে আহরণ করছেন মাছ। কিন্তু আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে সাগরে ইলিশ মাছ ধরার উপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আসছে। এতে অনেকটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন জেলেরা।

শহরের ফিশারিঘাট পাইকারি মাছের বাজার মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে উচ্চ দামে বেচাবিক্রি হচ্ছে ইলিশ। সেখান থেকে পাইকারী ব্যবসায়ীরা কিনে ট্রাকবোঝাই করে হাজার হাজার ইলিশ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাটবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু যে দেশের বিভিন্ন শহরে ইলিশ ঢুকছে তাই নয়, কক্সবাজারের ইলিশ যাচ্ছে ভারতেও । আসন্ন দূর্গা পূজাকে সামনে রেখে ভারতে বৈধ – অবৈধ পথে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইলিশ।

জেলেরা জানান, বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। যে কারণে ছোট আকৃতির নৌযানগুলো সাগরের ৭০-৯০ কিলোমিটার গভীরে পৌঁছে ইলিশ ধরতে পারছে না। যার ফলে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

জেলে রহমান আলী বলেন, সাগরে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে বেশি ইলিশ পাওয়া গিয়েছিল। অবাধে মাছ ধরার কারণে সাগরে ইলিশ কমে এসেছে। আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশ আহরণের উপর নিষেধাজ্ঞা আসছে। এতে হয়তো কিছুটা রক্ষা পাবে। তবে আমাদের মতো জেলেদের জন্যে কষ্ট হয়ে যায় । কারণ ইলিশ ধরতে না পারলে ট্রলারের মালিক আমাদের বেতন – ভাতা কমিয়ে দিবে।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কক্সবাজার জেলায় গত বছরের তুলনায় ইলিশের আহরণ বেড়েছে অনেক বেশী । জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেলেদের জালে ধরা পড়ছে রূপালী ইলিশ। বিশেষ করে ভাদ্র মাসের শুরু থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে রূপালী ইলিশ।জেলেরা শুধু যে ইলিশ ধরছে তা না রূপচাঁদা, সামুদ্রিক কোরালসহ নানা প্রজাতির মাছও ধরা পড়েছে ।

মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে দৃশ্যমান বেশী মাছ দেখা গেলেও বাড়তি দাম নিয়ে হতাশ ক্রেতারা। তাদের দাবী চলতি বছর যেকোন সময়ের চেয়ে মাছের দাম চড়া।যে কারণে সাধারণ মানুষ ভালো কোন মাছ কিনতে পারছেনা।

ট্রলার মালিক ওয়াজেদ আলী জানান, সাগরে ট্রলার পাঠাতে যে পণ্য দরকার তার মধ্যে তরকারি, তেল, মরিচ, মসল্লা, চাল ইত্যাদির দাম উর্ধমূখী । এছাড়া চোরাই পথে ইলিশ পাচারসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বাড়তি রয়েছে মাছের দাম । পর্যাপ্ত ইলিশ ধরা পড়লেও কক্সবাজারের খুব কম মানুষ ইলিশের দেখা পায় ।

তিনি আরও জানান, দাম বেশি হওয়ায় গরীব মানুষ ইলিশ খেতে পারেন না। ইলিশ এখন বিলাসী পণ্য । বড় বড় হোটেল – রেস্তোরাঁ, সরকারী আমলা,পূঁজিপতি ও অবৈধ আয় রোজগারে জড়িতদের রান্নাঘরে শোভা পাচ্ছে এই ইলিশ মাছ।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি নজির আহমদ বলেন – জালানী তেল,পরিবহন, শ্রমিক খরচসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাছের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাছের বাজার চড়া থাকলেও চাহিদা ও বিক্রি বেড়েছে। তবে সাধারণের নাগালের বাইরে। মানুষের জীবনযাত্রায় দৈনন্দিন ব্যয় বেড়েছে , সেই তুলনায় ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের দামবাড়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কক্সবাজার জেলা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের নির্বাহী কর্মকর্তা জিএম রাব্বানী জানিয়েছেন, সাগরে ইলিশ কমে এসেছে। যার কারণে গত কয়েকদিন ধরে সাগরে জেলেরা তেমন ইলিশ পাচ্ছেন না। সেপ্টেম্বর মাসে ৬৯৮ টন ৭৪ কেজি মাছ অবতরণ কেন্দ্রে আনা হয়। অবতরণ কেন্দ্রে আনা ট্রলারের মাছের রাজস্ব পায় সরকার । কিন্তু কক্সবাজারের চৌফলদন্ডী, নাজিরারটেক, টেকনাফ ও ইনানী মেরিন ড্রাইভসহ অসংখ্য জায়গায় অবৈধভাবে শতশত ট্রলারের জেলেরা মাছ নামিয়ে দিচ্ছে। এতে কাঁদা মাটিতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে মাছ, অন্যদিকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

তিনি আরও জানান, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে যেসব মাছ আসে সবগুলো পরিচ্ছন্ন জায়গায় রাখার সুযোগ আছে। এছাড়া মাছ পচনরোধে বরফ ও প্যাকেজিং এর সুযোগ রয়েছে। এতসব সুবিধা দিয়ে প্রতি ট্রলার থেকে সরকার সামান্য কিছু রাজস্ব পায়৷

এদিকে, ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে সারাদেশে ২২ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে ১৩ অক্টোবর এবং শেষ হবে ৩ নভেম্বর।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর