বন্যায় বিধ্বস্ত ফেনী: লাশ ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে কলা গাছের ভেলায়
মানব কথা: পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত ফেনী। বন্যা কেড়ে নিয়েছে সবকিছু। এই সব কেড়ে নেয়ার মিছিলে যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের বেদনার ভয়াবহতা হৃদয়বিদারক। সব তলিয়ে যাওয়ায় মাটির অভাবে মৃত মানুষটির দাফন বা সৎকারের সুযোগ না পেয়ে ভাসিয়ে দিতে হচ্ছে কলা গাছের ভেলায়। স্বজনের লাশ যেন একটু মাটির ছোঁয়া পায় সে আশায় অনেকে লাশের সাথে কাগজে দাফনের অনুরোধ লিখে দিচ্ছেন। জীবনের এমনই ভয়াবহতা ছুঁয়ে যাচ্ছে ফেনীবাসীকে।
স্থানীয় সংবাদকর্মী নাজমুল হক শামীম জানান, শনিবার রাতে ফেনী শহরের মিজান রোডে সোনালী ব্যাংকের সামনে হাঁটু পানিতে একটি শিশুর (৫) লাশ ভেলায় ভাসতে দেখি। কয়েকজন মানুষ সেই লাশটির জানাজা ও দাফনের জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় সেটি দাফন করা হয়েছে, তা আর জানা যায়নি।
গত রোববার ফেনী সদর উপজেলার লালপোল এলাকার উত্তর গোবিন্দপুর গ্রামে বন্যায় ভেসে আসে আরেকটি শিশুর লাশ।
উত্তর গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা পপি মজুমদার বলেন, ‘রোববার সকালে আমার স্বামী ডোবায় আনুমানিক পাঁচ বছরের এক শিশুর লাশ ভেসে থাকতে দেখে লোকজনকে খবর দেন। তারপর কয়েকজন ধরাধরি করে লাশটি এনে সড়কের পাশে রাখেন।’
স্থানীয় জয়নাল মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, শিশুটির চোখ দু’টি ফুলে সাদা হয়ে গেছে। শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। শিশুটির শরীরের ভেতর পানি ঢুকে একদম ফুলে গেছে। লাশের সাথে একটি কাগজে অনুরোধ করে লেখা হয়েছে- বন্যার মধ্যে মাটি না পেয়ে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়। কেউ লাশ পেলে যেন কবর দেয়া হয়।
ফেনী জেলা জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক আ ন ম আব্দুর রহিম জানান, শনিবার সদর উপজেলার মৌটবী ইউনিয়নের সাতসতী গ্রামের নুরুল আলম (৬৫) মারা যান। পরে তার লাশ পরিবারের সদস্যরা কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেন।
একইদিন সদরের কালীদহ রেললাইনের পাশে একটি অর্ধগলিত লাশ ভাসতে দেখেছেন বলে জানান তিনি।
ওমানপ্রবাসী মাসুদ খান ফেসবুকে এক পোস্টে লেখেন, তার বাবা আলীম উল্লাহ (৭৩) মারা যাওয়ার পর লাশ কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। আলীম উল্লাহ সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাতসতী গ্রামের নাছির ভূঁইয়া বাড়ির বাসিন্দা। শুক্রবার ভোরে মারা যান তিনি। তখন পুরো গ্রাম পানিতে তলিয়ে থাকায় তার দাফনের ব্যবস্থা করা যায়নি।
শনিবার স্বজনরা লাশ কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। সাথে একটি চিরকুটে তাকে দাফনের অনুরোধ করা হয়। সেখানে ঠিকানাও দেয়া হয়।
চিরকুটে লিখে দেয়া হয়, এই লাশটি অতিরিক্ত বন্যার কারণে আমরা দাফন করতে পারিনি। দু’দিন অতিবাহিত হওয়ার পরে আমরা পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছি। সাথে আমাদের এলাকার নাম-ঠিকানাসহ ফোন নম্বর দেয়া হয়েছে। যদি কেউ শুকনো জায়গা পান, তাকে কবর দিয়ে দেবেন এবং আমাদের এই ঠিকানায় যোগাযোগ করবেন। আপনাদের কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকব’।
ফেনী সদর উপজেলার একটি গ্রামে বন্যার পানিতে লাশ ভাসছে উল্লেখ করে সাংবাদিক ফারাবী হাফিজ তার ফেসবুকে একটি লাশের তথ্য জানিয়ে লেখেন, কলার ভেলায় লাশ ভাসছে। প্লাস্টিকে লেখা, মুসলিম মহিলা। পারলে জানাজা পড়ে দিয়েন।
জানা যায়, দাফনের জন্য জায়গা না পেয়ে বানের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় শিফু (৪২) নামের ওই নারীকে। বৃহস্পতিবার বন্যায় মারা যান তিনি।
ফেনী সদর উপজেলার উত্তর ধলিয়া গ্রামের লতিফ হাজী বাড়ির মৃত নুরুল আমিনের মেয়ে শিফু। তার ভগ্নিপতি শাহেদুল হক জুয়েল জানান, শিফুর দাফনের ব্যবস্থা করে দিতে প্রশাসনের কাছে বার বার অনুরোধ করা হয়েছিল। সহযোগিতা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে পানিতে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে।
এদিকে ফেনী নদীতে পড়ে নিখোঁজের তিন দিন পর মো: জাহেদুল ইসলাম (১৭) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে এলাকাবাসী ফেনী নদীর আমলীঘাট সীমান্তে নিখোঁজ হওয়া যুবকের লাশটি ভাসমান অবস্থায় দেখে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। এর আগে রোববার রাত ১০টার দিকে উপজেলার ১ নম্বর করেরহাট ইউনিয়নের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে রেখার জিরো পয়েন্টের আমলীঘাট এলাকার মেরকুম নামকস্থানে নৌকা থেকে পড়ে নিখোঁজ হন জাহেদুল। তিনি পূর্ব অলিনগর গ্রামের মো: ফারুক ইসলামের ছেলে।
ফেনী আল জামিয়াতুল ফালাহিয়া আশ্রায়ন প্রকল্পের মো: আজিজুর রহমান জানান, বন্যার পানিতে ভেসে আসা পাঁচটি লাশ গত শনিবার ও রবিবার দাফন করেছেন। এছাড়াও আশ্রয়ন প্রকল্পে স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া তিনজনের লাশও দাফন করেছেন।
বন্যার পানিতে লাশ ভেসে আসার আরো কিছু তথ্য ফেসবুক পোস্টে দিয়েছেন অনেকে। তবে তাদের তথ্য যাচাই করা যায়নি।
এদিকে জেলা প্রশাসনের কাছে বন্যায় একজনের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার।
সূত্র : ইউএনবি