আলমগীর কবিরের নারী কেলেঙ্কারি, প্রধান উপদেষ্টার কাছে অভিযোগ

সময়: 1:17 pm - June 25, 2025 |

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের নারী কেলেঙ্কারির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ও দুদক চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে।

বুধবার জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাউথইস্ট ব্যাংকের একটানা ২০ বছরের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের ঋণ কেলেঙ্কারি, নারী কেলেঙ্কারি ও শেয়ার কারসাজিতে পথে বসতে চলেছে বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংক। নিয়ম বহির্ভূতভাবে একটানা ২০ বছর চেয়ারম্যান থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছেন বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবির। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ঋণ কেলেঙ্কারি, শেয়ার কারসাজিসহ নানাভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের মাধ্যমে ব্যাংকটির হাজার হাজার গ্রাহকের আমানতকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন।

শুধু অর্থ কেলেঙ্কারি নয়, আলমগীর কবিরের বেশ কয়েকটি নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয়েছে ব্যাংটিতে। বিভিন্ন নারীর সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ আলাপ ও যৌন হয়রানি করেছেন তিনি। আলমগীর কবির পছন্দমাফিক কতিপয় অধস্তন নারী কর্মকর্তাদের নিজ অফিসে ডেকে নিয়ে যেতেন। কখনোবা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় একান্ত সময় কাটাতেন। কতিপয় নারী সদস্যকে বাধ্য করতেন যৌন সম্পর্কে জড়াতে। আলমগীর কবির বছরের পর বছর এমন অনেক নারীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়ানোর নেশায় মেতেছিলেন। কিছু নারী কর্মকর্তাও পদোন্নতি, অর্থবিত্ত আর অবৈধ প্রভাব বিস্তারের নেশায় তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেন।

আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তার ফ্লোরে ছিলো সুন্দরী নারীদের আনাগোনা। তিনি একাধিক সুন্দরী নারীকে এপিএস বানিয়েছেন। অনেক নারীকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেয়িছেন। তাকে নারী সরবরাহ করতেন একটি দালাল চক্র। যারা নারীর বিনিময়ে তার কাছ থেকে বাগিয়ে নিয়েছেন বড় বড় লোন।

আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংক পরিচালিক স্কুল ও বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে তার কয়েকজন সখের নারীকে চাকরি দিয়েছেন। নারী লিপ্সু আলমগীর কবির একটা সময় অর্থের পাশাপাশি যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বয়সের ভারে নুজ্য আলমগীর কবির সবসময় বুদ থাকতেন নারীতে।
আলমগীর কবির দ্বারা নির্যারিত একাধিক নারী এ বিষয়ে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বেশ কয়েকজনের কাছে তার সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক পদ বাতিলের জন্যও আবেদন করবেন বলে জানাগেছে।

২০০৪ সাল থেকে বিরতিহীনভাবে টানা ২০ বছর অনিয়ম-লুটপাট-অর্থপাচারের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি। আলমগীর কবির একক আধিপত্য দেখিয়ে নিজস্ব লোকদের ঋণ দেওয়া, চলতি ঋণের সুদ মওকুফ করে দেওয়া এবং নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য পরিচালকরা আপত্তি করলেও বিশেষ সুবিধা নিয়ে একক ক্ষমতায় অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ অনুমোদন করেছেন। অবশ্য শুধু ঋণ নয়; ব্যাংকের সরঞ্জামাদি ক্রয়, শাখা সম্প্রসারণ, শাখার ইন্টেরিয়র, ব্যাংকের বুথ বসানো থেকে শুরু করে সফটওয়্যার সরবরাহসহ সব ক্ষেত্রেই ছিল কর্তৃত্ব। আর এভাবেই ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন এই ব্যাংক মাফিয়া। যা দিয়ে দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। অর্থ পাচারের মাধ্যমে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বিলাসবহুল বাড়ি, হোটেল ও বার। দেশেও গুলশান, বসুন্ধরা ও বাংলামোটরে একাধিক ফ্ল্যাট, গাজীপুরে বাড়ি, শ্রীপুর-ভাওয়াল এবং কাঁচপুরে শত শত বিঘা জমি আছে। এদিকে অনিয়ম-লুটপাটের এখানেই শেষ নয়; চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় এবং ছেলে রাইহান কবির ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালীন বাপ-বেটা ব্যাংক থেকে লুটপাট করে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, বে লিজিং এবং এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের বিপুল পরিমাণ শেয়ার ক্রয় করেন। লক্ষ্য ছিল ব্যাংকের টাকায় শেয়ার কিনে ওই সব প্রতিষ্ঠান দখল করা। ওই সব প্রতিষ্ঠানের কোথাও পরিচালক আবার কোথাও উপদেষ্টার পদ দখল করেছেন আলমগীর কবির। এমনকি নিজস্ব দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে অনৈতিকভাবে মোটা অঙ্কের ঋণও অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। যা নিয়ে এখন বিপাকে ব্যাংক।

সাউথইস্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই দশক ধরে সাউথইস্ট ব্যাংকের সবকিছুই আলমগীর কবিরের ইশারায় পরিচালিত হয়েছে। বাছবিচার ছাড়াই ব্যাংকের টাকা তিনি কখনো পারিবারিক প্রতিষ্ঠান, কখনো বিশেষ সুবিধা নিয়ে নামে-বেনামে ঋণ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন ব্যাংকের পরিষদে থাকা তার বন্ধুরা। আর অনিয়ম-দুর্নীতিতে দুর্বল হয়ে পড়া ওই সব প্রতিষ্ঠান এখন আর টাকা ফেরত দিতে পারছে না। যার ফলে বিপাকে পড়েছে দেশের স্বনামধন্য ও র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে থাকা এই ব্যাংকটি। যদিও কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা বর্তমান পরিচালনা পরিষদের যোগ্য নেতৃত্বে আবারও ঘুড়ে দাঁড়াবে সাউথইস্ট ব্যাংক।

এদিকে শেয়ার কারসাজির হোতা হিসেবে পরিচিত আলমগীর কবিরের রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের একাধিক পরিচালকও জড়িত রয়েছেন। হাজার হাজার গ্রাহক শেয়ার কারসাজির সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে পথে বসেছে। এমনকি ছাত্র-জনতার বিপ্লবে স্বৈরাচার হাসিনার ভারতে পলায়নের পর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা এই চক্রটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে অভিযোগও দিয়েছেন। যার ফলে কমিশন গত ১৯ নভেম্বর ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির দায়ে আলমগীর কবিরকে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করেছে। একই সঙ্গে অভিযোগ রয়েছে নিকটাত্মীয় (বেয়াই) এর প্রতিষ্ঠান লুব-রেফ বাংলাদেশকে বেআইনিভাবে ৫৪ কোটি টাকার অধিক সুদসহ ঋণ মওকুফ করে দিয়েছেন। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে- ২০ বছর চেয়ারম্যান থাকাকালীন স্বৈরাচার হাসিনার কোষাগারে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন। মোটকথা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সাউথ ইস্ট ব্যাংককে খাদের কিনারে নিয়ে গেছেন আলমগীর কবির।

এদিকে আলমগীর কবিরের সময়ে অনিয়ম করে দেওয়া ব্যাংকটির ২৩২ কোটি টাকা ফেরত দিচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। ব্যাংকের মূল কার্যক্রমের পাশাপাশি ব্যাংকটির ফাউন্ডেশন ও গ্রিন স্কুলের তহবিলও প্রতিষ্ঠানটিতে আটকা পড়েছে। মেয়াদি আমানত ও কলমানি হিসেবে এ অর্থ ধার দিয়েছিল ব্যাংকটি। টাকা ফেরত চেয়ে বারবার চিঠি দেয়া হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি থেকে কোনো সাড়া মিলছে না। মূল অর্থের পাশাপাশি সুদও পরিশোধ করছে না বলে সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে জানানো হয়। বে লিজিং মূলত আলমগীর কবিরের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগম বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া গত সেপ্টেম্বরে পরিষদ পুনর্গঠনের আগ পর্যন্ত বে লিজিংয়ের প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান খানও সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিষদে ছিলেন। আবার প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদা গণি সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৪-এর এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এ মুহূর্তে সাউথইস্ট ব্যাংকের পাওনা টাকা পরিশোধ করার সক্ষমতা বে লিজিংয়ের নেই। প্রতিষ্ঠানটিকে টাকা ধার দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৭ (১-খ) ধারা লঙ্ঘন করেছে সাউথইস্ট ব্যাংক। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রুগ্ন এ প্রতিষ্ঠানের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ছিল ১৭২ কোটি টাকা। আলমগীর কবিরের ঘোষণাপত্র অনুযায়ী, বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুরাইয়া বেগম তার স্ত্রী। সে হিসাবে ব্যাংকের সঙ্গে বে লিজিংয়ের লেনদেন ‘ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে লেনদেন’ বলে গণ্য হবে।

উল্লেখ্য, ২০০৪ থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ২০ বছর সাইথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আলমগীর কবির। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন। তবে এতো অনিয়মের পরেও পরিচালক হিসেবে এখনো সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিষদে রয়েছেন।

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর