ওরা ১১ জন, গণপূর্তে শেখ হাসিনার আশীর্বাদ প্রাপ্ত দূর্ণীতির বরপুত্র
নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই বিপ্লবের শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকুরিতে, বিশেষ করে বিসিএস চাকুরিতে কোটা পুনর্বহালকে কেন্দ্র করে। এই কোটা বিরোধী আন্দোলনই পরে সর্বাত্মক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়, যার ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
গণপূর্তে শেখ হাসিনার আশীর্বাদ প্রাপ্ত দূর্ণীতির বর পুত্র এই ১১ জন না দিয়েছেন প্রিলিমিনারি, না দিয়েছেন লিখিত পরীক্ষা। শুধুমাত্র একটি ভাইবা দিয়ে সরাসরি সিনিয়র এসিস্টেন্ট সেক্রেটারির সমান বেতন গ্রেডে নিয়োগ পেয়ে যান।
উল্লেখ্য, এ যেন ১৯৭৩ সালের তোফায়েল কমিশনের পুনরাবৃত্তি। শেখ মুজিব যেমন ১৯৭২ এ ক্ষমতায় আসার ২ বছরের মাথায় বাকশালী আমলাতন্ত্র কায়েমের জন্য তোফায়েল কমিশনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের গুন্ডাদের ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, হাসিনাও তেমনি ২০১২ সালে এই ১১ ভারতীয় এজেন্টকে বিসিএস ক্যাডার বানিয়ে দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নজির বিহীন নৈরাজ্যের এই নিয়োগটিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের তৎকালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী চিত্তরঞ্জন দাস। তিনি ততকালীন প্রধান প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূইয়া, তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সার্কেল-১ আব্দুল কাদের চৌধুরী ততকালীন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবন) আহমেদ আনোয়ারুল নজরূল (যিনি বর্তমানে তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী যশোর গণপূর্ত সার্কেল) মিলে ১১০ কোটি প্যাকেজে এই অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।
কবির আহমেদ ভুইয়া আপাদমস্তক বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতা ছিলেন, তিনি আইইবি তে প্রথম ভোট ডাকাতির জনক এবং ২০১৫ সালের বিনা ভোটে আইইবি এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সার্কেল-১ আব্দুল কাদের চৌধুরী আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর কেসিনো কান্ডে জি কে শামীম গ্রেফতার হলে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসাবে তাকেও দুদকে তলব করা হয়।
ততকালীন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবন) আহমেদ আনোয়ারুল নজরূল (যিনি বর্তমানে তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী যশোর গণপূর্ত সার্কেল) ২১ তম বিসিএসের এই কর্মকর্তার বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ দোহারে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্্যন্ত হাসিনা সরকারের পূর্ত প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আব্দুল মান্নান খানের ভাগিনা ছিলেন আহমেদ আনোয়ারুল নজরুল। নজরুলের তৃতীয় স্ত্রী মান্নানের এপিএস এর ভগ্নি। সে সময় আনোয়ারুল নজরুলই পূর্ত মন্ত্রনালয় নিয়ন্ত্রন করতেন। আনোয়ারুল নজরুল নিজেও ছাত্র জীবনে একজন গর্বিত ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিলেন বলে তার শিষ্যদের পুনর্বাসনে মুখ্য ভুমিকা পালন করেছেন। গণপূর্ত ই/এম ক্যাডারে যখন এই ১১ জঙ্কে সরাসরি উপবিভগীয় প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেয়া হয় তখন ৩১ তম বিসিএস এর কর্মকর্তা গন সার্ভিসে ছিলেন। একজন বিসিএস কর্মকর্তা ভীষন কঠিন প্রতিযোগিতা মূলক প্রিলিমিনারি; লখিত; ভাইবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পরেই ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্তহন। এরপর ২ বসছর সন্তোস জনক চাকুরি; বিভাগীয় পরীক্ষা পাস এবং বুনিয়াদি প্রশিক্ষন সফল ভাবে সম্পন্ন করলে তার ৯ম গ্রেডে চাকুরি স্থায়ী হয়। তারপর চারবছর পূর্তিতে সিনিয়র স্কেল পদোন্নতি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার যোগ্য হন। সিনিয়র স্কেল পদোন্নতি পরীক্ষায় পাস করলে তবেই একজন বিসিএস ক্যাডার ৬ষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পান। কিন্তু এই ১১ জন যে এত সব কিছু থেকে দায় মুক্তি দিয়ে সরাসরি উপবিভগীয় প্রকৌশলী পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
২০১২ সালে পেছন দরজা দিয়ে নিয়োগ পাওয়া এই ১১ জনকে আবার সিনিয়রিটি দেয়া হয়েছে ২০০৮ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৭ তম বিসিএস এর আগে। ফলে সংঘুব্ধ বিসিএস কর্মকর্তারা দারে দারে ঘুরে ইনসাফ না পেয়ে মামলা করতে বাধ্য হন। কিন্তু ফ্যাসিবাদের সময় আদালত যে বিচারকলীগ আর আইনজীবি লীগের ক্যাঙ্গারু কোর্ট ছিলো তা আর কারও অজানা নয়। মামলা করে বিচার তো পানইনি, উলটা কাদের-নজরুল-চিত্তরঞ্জন গংদের রোষাণলে পড়ে নিবর্তন মূলক বদলীর স্বীকার হয়েছেন। এই ১১ জন দম্ভ ভরে বলে বেড়াতেন ততকালীন এটর্ণী জেনারেল মাহবুব-ই-আলম কে জন প্রতি ১১ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। আইন জীবির ফি জন প্রতি ২৮ লক্ষ টাকা তাদের খরচ হয়েছে। এভাবে অঢেল টাকা ঢেলে এই ১১ দুর্বৃত্ত আদালতের রায় কিনে এনেছিলেন। ফলে হতাশ কর্মকর্তা গন অনেকেই ক্যাডার ছেড়ে ডি এস পুলে চলে গিয়েছেন। এই ১১ জন ফ্যাসিবাদের পুরোটা সময় দূর্নীতির রাম রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এরা বুঝে গিয়েছিল টাকার জোড়ে এরা যে কাউকে ম্যানেজ করতে পারবে।
এই তালিকায় প্রথমে রয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়া উর রহমান। যিনি আরেক ছাত্রলীগ ক্যাডার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের ক্যাশিয়ার। প্রধান প্রকৌশলীর টেণ্ডার বানিজ্যের লেনদেন জিয়ার একটি বিশেষ হোয়াটসএপ নাম্বারে হতো। তাই অনেকে তাকে হোয়াটসএপ জিয়া/ বিকাশ জিয়া ইত্যাদি নামে ডাকেন। দ্বিতীয় মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, তার বিরুদ্ধে দলীয় ক্যাডার গিরি, সন্রাসে মদদ দেয়া, টেণ্ডার বানিজ্য, নামে বেনামে ঠিকাদারি কাজ না করে বিল উত্তোলন সহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
তিনি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের নেতা হিসাবে বদলী বানিজ্যের সিন্ডিকেটে সক্রিয় ভুমিকা রাখতেন। শম রেজাউল করিম ও তার ভাইদের সাথে তার ব্যবসায়িক অংশিদারিত্ব রয়েছে। এর পরে ছিলেন ফরিদ পুরের রিজাউল করিম; যিনি পুলিশের অতিরিক্ত আইজি পলাতক খুনি মনিরুল ইসলাম ও যুগ্মসচিব শায়লা ফারজানা দম্পতির নিকট আত্মীয়। এরপরেই আছেন লাম্পট্য আর দূর্নীতির মাস্টার শরীফ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাসুম। লিংবাজ এই কর্মকর্তা অদক্ষতা জনিত কারনে অনেকবার ধিকৃত হয়েছেন।
এই এগার জনের মধ্যে সবচেয়ে চিহ্নিত হলেন সমীরন মিস্ত্রী। তিনি বাগের হাট থেকে ঢাকায় আসেন পলাতক তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জাহেদার দ্বিতীয় স্বামী রোকন উদ্দিনের হাত ধরে। রোকন উদ্দিন গোপালী পুর্ত সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকারের ক্যাশিয়ার ছিলেন। এরপর সমিরন শহীদুল্লাহ খন্দকারের বেকার পুত্রদ্বয়কে ঠিকাদারি কাজ দিয়ে হৃদয় জয় করে নেন। শহীদুল্লাহ খন্দকারের ছত্র ছায়ায় সংসদ ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ন জায়গায় পাচ বছর ছিলেন। এর পর সচিব কাজী ওয়াসি উদ্দিনের সাথেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলেন। শরীফ আহমেদ প্রতিমন্ত্রী থাকা কালে তাকে টাকা পয়সা -মদ-নারী সাপ্লাই দিয়ে বদলি বানিজ্যের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করতেন। বিগত পাচ বছরে সমীরন মিস্ত্রী অন্তত ২৫ বার আমেরিকা, ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। হাই প্রোফাইল দের নিয়ে প্রমোদ ভ্রমন করতেন বিধায় তার জিও পেতে কখনও সমস্যা হয় নি। এমন কি মন চাইলে নিয়ন্ত্রঙ্কারী পূর্ত মন্ত্রনালয় কে পাশ কাটিয়ে অন্য মন্ত্রনালয় থেকে জিও করে বিদেশ চলে যেতেন। এই সফর গুলোতে তিনি মূলত ফ্রান্স; যুক্তরাষ্ট্র; ইউ কে; দুবাই; সুইজারলয়ান্ডে শহীদুল্লাহ খন্দকারের টাকা পাচার করে দিয়ে আসতেন। নিজেও ভারত সহ এসব দেশে বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এই তালিকায় আইউব আলী সহ অপরাপর সদস্যরাও সকলে দূর্নীতিবাজ টাকা পাচার কারী এবং সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী।
এই বৈষম্য বিরোধী বাংলাদেশে আমরা এই অনিয়মের তদন্ত চাই। চাই এই বাকশালীদের বরখস্ত করে যথাযথ নিয়মে বিসিএসের মাধ্যমে বেকার যুবক ও যুবা মিহিলাদের নিয়োগ দেয়া হোক। আর এই নিয়োগে গণ পূর্ত অধিদপ্তর, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়, বিপিএসসির যে সকল ততকালীন কর্মকর্তা এই নিয়োগের সাথে জড়িত ছিলেন তাদের তদন্ত পূর্বক শাস্তির দাবি জানিয়েছে গণপূর্তের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।