পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ : বিজেপির কারণে কি সুবিধা হলো মমতার?
মানব কথা: কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় প্রথমে সাধারণ নাগরিকরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন। তাদের নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, তাই কিভাবে তাদের মোকাবেলা করা হবে, তা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং মমতা ব্যানার্জীর সরকার চিন্তায় ছিল।
তবে সম্প্রতি প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সরাসরি ওই ঘটনার প্রতিবাদে নেমে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছে। চেনা-জানা রাজনৈতিক বিরোধীদের মোকাবেলা সরকার আর ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সুবিধাজনক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘স্কুলের বাচ্চাগুলো পর্যন্ত রাস্তায় নেমে গেছে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রতিবাদ মিছিল করছে,’ কলকাতার একটি স্কুলের বর্তমান ও সাবেকদের মিছিল দেখতে দেখতে মন্তব্য করছিলেন এক পথচারী।
কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে নেমেছিলেন ওই স্কুলটির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।
ওই ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর থেকে দুই সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল, প্রতিদিনই একাধিক ছোট-বড় মিছিল-জমায়েত হচ্ছে কলকাতা বা শহরতলির রাস্তায়।
এসব মিছিল-জমায়েতের জন্য নিয়মিতই যানজট লেগে থাকছে। তবে ওই যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে পড়া কাউকেই বিশেষ বিরক্ত হতে দেখা যাচ্ছে না, যেটা সবসময়েই রাজনৈতিক মিছিল-জমায়েতের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়।
চায়ের দোকানে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দুই বন্ধুর মধ্যে আলোচনা কানে এলো– ‘এটা কোথায় গিয়ে থামবে বোঝা যাচ্ছে না।’
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও সম্ভবত বুঝতে পারছিল না সাধারণ মানুষের এই প্রতিবাদ কোথায় গিয়ে থামবে।
আরজি কর হাসপাতালের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বিচার চেয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন প্রতিবাদে নামলেও সিংহভাগ প্রতিবাদ মিছিলের সংগঠক বা যোগদানকারীরা একেবারেই সাধারণ নাগরিক।
তবে প্রথমদিকের ওই প্রতিবাদ মিছিলগুলোতে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যে অংশ নেননি, তা নয়। এমনকি রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা-নেত্রী ঘোষণা দিয়েই মিছিলগুলোতে যোগ দিয়েছিলেন – বিশেষত ১৪ আগস্টের ‘রাতের রাস্তা দখল’ কর্মসূচিতে।
ছিলেন অন্যান্য দলের নেতা-নেত্রীরাও। কিন্তু কারো গলায় সেদিন কোনো দলীয় স্লোগান শোনা যায়নি, দেখা যায়নি কোনো দলের পতাকাও।
এরকম একাধিক মিছিল-জমায়েতে যোগ দিচ্ছেন ২৫ বছর বয়সী চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির ছাত্র অঙ্কুশ পাত্র।
তিনি বলেন, ‘অনেক স্কুল-কলেজের মিছিলেই দেখছি সাধারণভাবে একটা আবেদন থাকছে যে দলবিহীন, দলীয় পতাকা-বিহীনভাবে প্রতিবাদে শামিল হওয়ার কথা। তাদের নিজেদের মধ্যে হয়তো ডিবেট হচ্ছে, মতানৈক্য হচ্ছে, তবে যখন তারা পথে নামছেন, সেখানে কেউ কিন্তু কোনো দলের কথা বলছেন না বা দলীয় প্রভাব থাকছে না।’
“তাদের গলায় মূলত যে স্লোগান শোনা যাচ্ছে, তা হলো ‘বিচার চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’,” বলেন তিনি।
পথে নামতে দেখা যাচ্ছে এমন বহু নারী-পুরুষকে, যাদের কাছে রাস্তায় নেমে কোনো ঘটনার প্রতিবাদ এই প্রথম।
অঙ্কুশ পাত্র বলেন, ‘আবার যখন প্রধান বিরোধী দলকে প্রতিবাদে নামতে দেখা যাচ্ছে, সেটা দেখে অনেক সাধারণ নাগরিক কিন্তু প্রতিবাদ থেকে শারীরিকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, মানসিক সমর্থন থাকবে এই ইস্যুর প্রতি কিন্তু রাজনীতি যখন ঢুকে পড়েছে তখন আর সরাসরি সামনে আসব না আমরা। এই দুই ধরনের আখ্যানই আমি দেখতে পাচ্ছি।’
‘অচেনা-অজানা’দের মোকাবেলা কিভাবে?
পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের নাগরিক-প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিন পরে। এর আগে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে কিছুটা এ ধরনের নাগরিক প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল।
তবে সেটি ছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের নীতির বিরুদ্ধে। আর এবারের প্রতিবাদ যেমন হচ্ছে বিচারের দাবিতে, তেমনই উঠে আসছে সমাজে পুঞ্জীভূত ক্ষোভও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলেন, এই সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারের কাছে অভিনব।
‘এর একটা কারণ হলো এই প্রতিবাদীরা একেবারেই অচেনা-অজানা। কিভাবে এদের মোকাবেলা করা হবে, সেটা ক্ষমতাসীন দল বা সরকার জানে না,’ বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদ- যেটা শুরু হয়েছিল ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়া এক নারীর বিচারের দাবিতে, বৃহত্তর প্রেক্ষিতে নারী-সুরক্ষার দাবিতে। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সেভাবে সরাসরি এই আন্দোলনে ছিল না গোড়ার দিকে। তারা দেখলো যে পতাকা ছাড়া কোনো প্রতিবাদে তো ব্যাপক সাড়া পড়ছে, তাই এখন বিজেপি নেমে পড়লো নবান্ন ঘেরাও বা বনধ ইত্যাদিতে। সেটা আদৌ সাড়া ফেলেছে কি না, তা ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু বিজেপির আন্দোলন মোকাবেলা করা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে অনেক সুবিধাজনক। কারণ এটা দুপক্ষের কাছেই চেনা রাজনৈতিক ময়দান, চেনা প্রতিপক্ষ।’
‘আমাদের তো একটাই চাওয়া– বিচার’
রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে নেমে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তুলেছে।
আর এই দাবি ওঠার পরেই তৃণমূল কংগ্রেস টেনে আনছে বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে ঘটে যাওয়া নৃশংস ধর্ষণ-হত্যার নানা ঘটনার কথা।
যখন আরজি করের ঘটনার বিচার এবং মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছে বিরোধী দল, তখন ক্ষমতাসীন দল নিজেরাও দোষীদের ফাঁসি চাইছে।
এই রাজনৈতিক দাবি-পাল্টা দাবিতে কেউ কেউ মনে করছেন ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হওয়া তরুণী চিকিৎসকের বিচারের দাবিটা কিছুটা লঘু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গত প্রায় ২০ দিন ধরে নানা প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছেন কলকাতার পেশাজীবী সুজাতা ঘোষ।
তিনি বলেন, ‘আমাদের তো একটাই চাওয়া– বিচার। ওই তরুণী চিকিৎসক যেন বিচার পায়। তবে এখন যা দেখছি, ব্যাপারটার মধ্যে বিজেপি চলে আসায় বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে ঘটে যাওয়া একই ধরনের নৃশংস ধর্ষণ-হত্যার প্রসঙ্গ টেনে আনছে তৃণমূল কংগ্রেস।’
‘হাথরাস-উন্নাও বা কাঠুয়ার ঘটনাগুলো কোনো অংশেই কম নৃশংস ছিল না। কিন্তু বিষয়টাতে রাজনৈতিক দলগুলো চলে আসার ফলে আমাদের মেয়েটির বিচারের দাবি লঘু হয়ে যাবে না তো? এই প্রশ্নটা আমার বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছে,’ বলেন তিনি।
সুজাতা ঘোষ আরো বলেন, ‘ওই ১৪ আগস্ট রাতে যেভাবে সব রাস্তায় শুধু কালো মাথা দেখা গিয়েছিল, সেরকমই যদি করে দেয়া যেত, তাহলে মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলো এই নৃশংস ঘটনা নিয়ে তাদের পরিচিত বিতর্ক করতে পারত না। তারা এটা টের পেত যে সাধারণ মানুষ আসলে যে শুধুই বিচার চায়। একজন মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগটা তো দাবি নয়!’
বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলেন, ‘এই প্রতিবাদ আন্দোলনে নারীরা যে বিচারের দাবি তুলেছিলেন, তার সাথেই নারীদের নিরাপত্তার দাবিও উঠেছিল। এই নিরাপত্তার সামাজিক দাবিটা আবার বহুমাত্রিক ছিল। এখন রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে ঢুকে পড়ার ফলে ওই সামাজিক দাবিগুলো হারিয়ে যাবে কি না, তা সময়ই বলবে।’
সূত্র : বিবিসি