মার্কিন মধ্যস্থতা যেভাবে যুদ্ধ থামাল

সময়: 9:15 am - May 12, 2025 |

মানব কথা: শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একেবারে আচমকাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা করেন, ভারত ও পাকিস্তান চার দিন ধরে চলমান সীমান্ত সংঘর্ষের পর ‘সম্পূর্ণ এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে’ সম্মত হয়েছে। চলমান সঙ্ঘাতে এটা ছিল নাটকীয় একটা মোড়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্দার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীদের, কূটনৈতিক ‘ব্যাকচ্যানেলের’ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূমিকা পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকে বিপর্যয়ের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

তবে যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টা পরই ভারত ও পাকিস্তান নতুন করে সমঝোতা লঙ্ঘনের অভিযোগে একে অপরকে পাল্টা দোষারোপ করতে থাকে, যা এই চুক্তির ভঙ্গুরতা প্রকাশ করে।

ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘বারবার সমঝোতা লঙ্ঘনের’ অভিযোগ তোলে, অন্য দিকে পাকিস্তান জানায় যে তারা যুদ্ধবিরতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে এবং তাদের বাহিনী ‘দায়িত্বশীলতা ও সংযম’ প্রদর্শন করছে।

ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতির ঘোষণার আগে, ভারত ও পাকিস্তান এমন একটি সংঘর্ষের দিকে এগোচ্ছিল, যা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধেও রূপ নিতে পারত বলে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন।

গত মাসে ভারত-শাসিত কাশ্মিরের পেহেলগামে এক প্রাণঘাতী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর, ভারতের দিক থেকে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মিরে বিমান হামলা চালানো হয়। যার ফলে টানা চার দিন ধরে ধরে আকাশপথে লড়াই ও তীব্র গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। শনিবার সকালে উভয়পক্ষের বিমানঘাঁটিতেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অভিযোগ উঠে।

বিবৃতির লড়াইও চরমে ওঠে, দু’দেশই দাবি করতে থাকে যে তারা প্রতিপক্ষের বড় ক্ষতি করেছে এবং প্রতিপক্ষের হামলা প্রতিহত করেছে।

ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো তানভি মদান বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ৯ মে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে যে ফোন করেছিলেন তা সম্ভবত একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল।

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখনো জানি না আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ ঠিক কী ভূমিকা পালন করেছে, তবে এটা স্পষ্ট যে গত তিন দিন ধরে অন্তত তিনটি দেশ- যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, তার সাথে যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবও এই উত্তেজনা প্রশমনে কাজ করেছে।’

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার পাকিস্তানি গণমাধ্যমকে বলেন, এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ‘তিন ডজন দেশ’ জড়িত ছিল। যাদের মধ্যে ছিল তুরস্ক, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র।

তানভি মদানের মতে, ‘প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এই টেলিফোন কলটা আরো আগে- ভারতের প্রাথমিক হামলার ঠিক পর পরই আসত, যখন পাকিস্তান ইতোমধ্যে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির দাবি করছিল এবং উত্তেজনা হ্রাসের সুযোগ ছিল, তাহলে হয়ত পরবর্তী সংঘর্ষ এড়ানো যেত।’

এটাই প্রথম নয় যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতা ভারত-পাকিস্তান সঙ্কট নিরসনে সাহায্য করেছে।

নিজের আত্মজীবনীতে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও দাবি করেছিলেন, ২০১৯ সালের ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার সময় তাকে এক ভারতীয় কর্মকর্তার সাথে কথা বলার জন্য ঘুম থেকে জাগানো হয়েছিল, যিনি আশঙ্কা করছিলেন পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করছে।

পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার অজয় বিসারিয়া অবশ্য লিখেছিলেন, পম্পেও পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা উভয়ই অতিরঞ্জিত করেছিলেন।

তবে কূটনীতিকরা বলছেন, এবার সঙ্কট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সে বিষয়ে একেবারেই সন্দেহ নেই।

অজয় বিসারিয়া বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইরের শক্তি। আগের বার পম্পেও দাবি করেছিলেন তারা পারমাণবিক যুদ্ধ ঠেকিয়েছিলেন। এবারো তারা হয়ত নিজেদের ভূমিকা অতিরঞ্জিত করে দেখাবে। কিন্তু এটা ঠিক, এবারে সম্ভবত তারা মূল কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে এবং দিল্লির অবস্থানকে ইসলামাবাদে জোরেশোরে তুলে ধরেছে।’

তবে সঙ্ঘাতের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশ নির্লিপ্ত ছিল, তাতেও কোনো ভুল নেই।

উত্তেজনা যখন চরমে উঠছে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স বৃহস্পতিবার বলেন, এই যুদ্ধ ‘আমাদের মাথা ঘামানোর ব্যাপার নয়’, তাই যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়াবে না।

তিনি ফক্স নিউজকে দেয়া একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা এই দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোগ রয়েছে … যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে বলতে পারে না যে তোমরা অস্ত্র সংবরণ করো। আমরা পাকিস্তানকেও সেটা বলতে পারি না। কাজেই আমরা কূটনৈতিক উপায়েই চেষ্টা চালিয়ে যাব।’

অন্য দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘আমি দু’দেশের (ভারত ও পাকিস্তানের) নেতাদেরই খুব ভালো চিনি এবং আমি চাই তারা নিজেরা সমস্যার সমাধান করুক … আমি চাই তারা থেমে যাক এবং আশা করি তারা এখন থামবে।’

লাহোর-ভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ইজাজ হায়দার বলেন, এবারের ঘটনায় আগেরগুলোর থেকে একমাত্র পার্থক্য ছিল, শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ছিল।

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আগের মতই ছিল, তবে এবার তারা শুরুতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি। তারা প্রথমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে এবং পরে হস্তক্ষেপ করেছে।’

পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন সঙ্ঘাত যখন চরমে পৌঁছায়, পাকিস্তান তখন ‘ডুয়েল সিগনাল’ বা দু’রকম বার্তা দিতে শুরু করে। একদিকে সামরিক প্রত্যাঘাত চলতে থাকে, অন্য দিকে তারা ‘ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটির’ (এনসিএ) বৈঠক ডাকার কথাও ঘোষণা করে, যা স্পষ্টতই পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগেরও ইঙ্গিত দেয়।

সঙ্কটের ঠিক এই পর্যায়েই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দৃশ্যপটে আসেন।

কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো অ্যাশলে জে টেলিস বলেন, ‘এখানে যুক্তরাষ্ট্র ছিল অপরিহার্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিওর প্রচেষ্টা ছাড়া এই পরিণতি কিছুতেই আসত না।’

তার পাশাপাশি ওয়াশিংটনের সাথে দিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও এই ফলাফলে আসতে সাহায্য করেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক এবং সেইসাথে তাদের বৃহত্তর কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থই যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের ওপর কূটনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ দেয়।

ভারতের কূটনীতিকদের মতে, এবার শান্তির লক্ষ্যে তিনটি পথে প্রচেষ্টা ছিল, যা অনেকটা ২০১৯ সালের পুলওয়ামা-বালাকোট ঘটনার সময়েও দেখা গিয়েছিল। এগুলো হলো;

প্রথমে বিশ্ব রাজনীতির অন্যান্য বিষয়ে মনোযোগ থাকলেও এবং ‘আমরা এতে জড়াব না’ যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের মনোভাব থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারাই কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে ‘অপরিহার্য মধ্যস্থতাকারীর’ ভূমিকা পালন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা হয়ত নিজেদের ভূমিকা অতিরঞ্জিত করে দেখাবেন কিংবা দিল্লি ও ইসলামাবাদ হয়ত সেটিকে ছোট করে দেখতে চাইবে, কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখনো অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সাথে জটিল।

তবে শনিবারের ঘটনাপ্রবাহের পর এই যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আবার জানিয়েছে, মূলত দু’দেশের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারাই এই যুদ্ধবিরতি করিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র নয়।

পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এই যুদ্ধবিরতি অনিবার্যভাবে ভঙ্গুর হবে। এটা খুব তাড়াতাড়ি এসেছিল, চরম উত্তেজনার মধ্যে। এবং ভারত মনে হয় এই যুদ্ধবিরতিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের চেয়ে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আর যেহেতু এটা খুব দ্রুত করা হয়েছে, তাই একটা চুক্তি সফল হতে গেলে যে ধরনের আশ্বাস বা নিশ্চয়তার উপাদানগুলো থাকা দরকার তাড়াহুড়া করে করার কারণে সেটা এক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকতে পারে।’

সূত্র : বিবিসি

Share Now

এই বিভাগের আরও খবর